সোনার নাও পবনের বৈঠা

0
186

ঘুট ঘুটে কালো অমানিষায় সাদা কাপড়ে মোড়ানো কোন এক চুল বুড়ি বসে থাকতেন নৌকার গলুইর উপর। ভয়ানক সেই কালো রাতে কিছু দেখা না গেলেও, বুড়ির আলো ঝলমলে নৌকা ঠিকই দেখা যেত। আগুনের ফুলকির মত ফোঁয়ারা ছুটিয়ে যেত। সাথে সাথে বেজে উঠতো কাসার ঝনঝনানি। অদ্ভূত সব তালে বাজতো কাঁসর। তালে তালে এগোতো নৌকা। ঢেউয়ের দুলুনিতে দুলতেন চুলবুড়ি। কোন বাইচা নেই, কোন বৈঠা নেই, কে বাইতো সেই সোনারঙ্গা নৌকা খানি? এই ধবল বুড়ির নৌকা খানিই সোনার নাও। বাতাসে ভর করে সেই নৌকার বাইচ হতো বলে পবনের বৈঠা। গা ছমছম করা সোনার নাও পবনের বৈঠার বাইচ হতো, আলফাডাঙ্গার টিকরপাড়া বাওড়ে। কেউ বিশ্বাস না করলেও কিচ্ছু করার নেই। অবিশ্বাস্য এই কাহিনী বাওড়ের আশে পাশের মানুষের মনে বদ্ধমূল হয়ে আছে অনেক অনেক বছর ধরে। পাড়াগ্রাম, হেলেঞ্চা, টিকরপাড়া, খোলাবাড়িয়াসহ যে কোন নবীন প্রবীনের কাছে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন। শুধু অমাবস্যা নয়, পূর্নিমায় বেজে উঠতো কাসরের ঝংকার। চাঁদের ঝলমল আলোয় চিকচিক করতো বাওড়ের ঢেউ। ১০/১৫ হাতের শাপলার ফুল পানির উপরে উঠে আসতো। ঠিক তার আগেই বুড়ির নৌকা শত রঙ্গা আলোর বিকিরন ঘটিয়ে উথাল পাথাল করে দিত বাওড়ের টলটলে পানি। বাইচের ঢেউ আঁছড়ে পড়তো, বড় ভয়ার্ত শব্দে। শুনতে গাল গল্প মনে হলেও বড় বড় মাছ আর ভূতুড়ে সব ভয়ের গল্প শুনে বড় হয়েছি আমরা। এক মন আধমন ওজনের মাছ পাওয়া যেত এখানে অহরহ। দাদির মুখে শুনেছি, শুশুকের ধাওয়ায় বড় আঁইড় মাছ ক্লান্ত হয়ে ডাঙ্গায় উঠে গেছে। দানবের মত আঁইড় মাছে টাকে কয়েক জনে কাঁধ করে বাড়ি এনেছে। কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে সে মাছ ভাগ করা হয়েছে সে সময়। এত্ত বড় বড় শৈল, বোয়াল, কাতল, রুই মাছে ভরপুর ছিল এ বাওড়। গভীর পানির সাথে আদি ভৌতিক সব গল্প কাহিনী গায়ের লোম খাঁড়া করে দেয়। এ বাওড়টা এখনো বয়ে বেড়ায় হাজারো ভয়ের কল্পকথা। প্রচুর মাছ। মানুষ কোঁচ দিয়ে, ছোট ছোট জাল দিয়ে মাছ মারছে। হাতের ঝুড়ি মাছে ভরে উঠছে। “আলা” ধরে মাছ ধরছে মানুষেরা। কিন্তু কিছু সময় পর ঝুড়ির মাছ কমতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সব মাছ শেষ। আলার আলোও ছোট হয় আসছে। এক সময় ধপ করে নিভে যায় আলা। হঠাৎ সামনে তাকাতেই মাথা ছাড়া একটা মানুষ। বুকের মাঝখানে তার আগুনের গোলা দু পা বাওড়ের দু পাড়ে। মাথায় সিঁদুরের ফোটা দেয়া গঁজার মাছের ভয়ে বাওড়ে নামতে ভয় পেত লোকেরা। পানি কমার সময়, গোসল করতে পানিতে নামলে লোহার শিকলে পা আটকে ধরেছে অনেকের। এ রকম অজস্র ভয়ানক মাছ কেন্দ্রিক গল্প জড়িয়ে আছে এখানে। অনেক দূরে থাকা মধুমতি ভেঙ্গে ভেঙ্গে চলে আসে বাওড়ের খুব কাছে। সম্ভবত ৯৮এর বন্যার আগেই দিগনগর- মাঝি টিকরপাড়ার সড়ক ভেঙ্গে যায়। এ সময় নদীর পলি মাটি ঢুকে পড়ে বাওড়ে। পললের ভারে ভরাট হতে শুরু করে বাওড়। আর ধীরে ধীরে আভিজাত্য হারাতে থাকে টিকরপাড়া বাওড়। বাওড় যখন ভেঙ্গে যায় তখনি বুড়ির সোনার নাও মধুমতিতে চলে যায়। এমন টাই ভাবেন এলাকার মানুষ। টিকরপাড়া বাওড় ঘিরে হাজারো গল্প কথা রয়েছে। যা লিখে শেষ করা যাবেনা। মধুমতির পলি মাটি বছরের বছর বাওড়কে সমতল করে ফেলেছে। গোল্লা বাওড় পুরোটায় নদীর পেটে চলে গেছে। লম্বা বাওড়ে শুকনো মৌসুমে ইরির বাম্পার ফলন হয়। নব্যতা হারানোর পরেও বছরে বছরে পলো নামতো। বাজারে কাড়া পিটিয়ে আয়োজন করা হতা পলো উৎসবের। এখন আর বাওড়ের অস্বিত্য নেই বললেই চলে। তবুও এখনো কেউ কেউ রাতের আধারে বাওড়ে নামতে চাননা। অনেকেই নাকি, অনেক কিছুই দেখেন এখানে, ভরা বর্ষায় মধুমতি যখন বাওড় ভরিয়ে দেয়, অথৈ পানি দিয়ে। টিকরপাড়া ব্রীজ থেকে মাকড়াইল পর্যন্ত ধু ধু করে পানি আর পানি। ঠিক এ সময়ের ভরা পূর্নিমায় কিংবা নিকষ অমাবশ্যায় অনেক প্রবীনেরা শুনতে পান কাঁসরের সেই ঝংকার। দেখতে পান সোনালী আলোর অদ্ভূদ আলোচ্ছটা”। যা বিদীর্ণ করে দেয় টিকরপাড়ার বাওড় কুলের বাসিন্দাদের বড় অবচেতনে!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here