অপহরণ আতঙ্কে কাঁপছে টেকনাফ

0
77

কক্সবাজার জেলা সদর থেকে প্রায় ৮২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত টেকনাফ উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। পর্যটন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কারণে এ উপজেলা গুরুত্বপূর্ণ। তবে ২০১৭ সালে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়ার পর নানা সংকটে পড়েছে টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা। রোহিঙ্গাদের মাদক ব্যবসা, খুন, অপহরণসহ নানা অপরাধে বিপর্যস্ত টেকনাফের মানুষ।

বিশেষ করে একের পর এক অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় এবং হত্যার ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এ উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়ায় অপহরণের ঘটনা বেশি ঘটছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তথ্যমতে, গত সাত মাসে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয়েছে অন্তত ৭০ জনকে। সর্বশেষ গত রোববার অপহরণের শিকার হয়েছে হ্নীলার দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ হোসাইন সূর্য। তার পরিবারের কাছে ইতোমধ্যে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছে অপহরণকারীরা।
স্থানীয় লেদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র সূর্য এলাকার সোলতান আহমেদের ছেলে। রোববার স্কুল ছুটির পর অপহরণ করা হয় তাকে। সোলতান জানান, দুর্বৃত্তরা ফোন করে বলছে যে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ না দিলে ছেলেকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হবে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হয়েছে। টেকনাফ থানার ওসি আব্দুল হালিম বলেন, শিশুটির পরিবার রোববার রাতে থানায় জিডি করেছে। এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

এর আগে আলীখালী ২৫ নম্বর ক্যাম্প থেকে অপহরণের শিকার হয়েছেন পাঁচজন রোহিঙ্গা। তাঁদের মধ্যে একজনকে হাতের কবজি কেটে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি এবং অপহৃত অন্য চারজনেরও খোঁজ পাওয়া যায়নি।

এ ছাড়া গত ২৮ এপ্রিল পাত্রী দেখতে গিয়ে অপহরণের শিকার হন কক্সবাজারের চৌফলদণ্ডী উত্তরপাড়ার মোহাম্মদ আলমের ছেলে জমির হোসেন রুবেল, তাঁর দুই বন্ধু ঈদগাঁও উপজেলার জালালাবাদ সওদাগরপাড়া এলাকার মোহাম্মদ ইউসুফ ও কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া এলাকার ইমরান। গত ২৪ মে টেকনাফের পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের গলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা এখন পুলিশের রিমান্ডে রয়েছে। অপহৃত অন্যরা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন।

এর আগে গত ২৪ এপ্রিল হ্নীলার জাদিমোরার নেচার পার্ক এলাকা থেকে পাঁচ রোহিঙ্গা কিশোর অপহৃত হয়। তারা সবাই হ্নীলা ইউনিয়নের নয়াপাড়া আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা। জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে এসব কিশোরকে মুক্ত করে আনা হয়েছে বলে তাদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন।
২৬ মার্চ নেচার পার্ক এলাকা থেকে অপহৃত হয়েছিল হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া এলাকার দুই কিশোর। এক দিন পর সন্ত্রাসীদের ৪ লাখ টাকা দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয় তাদের।

পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুক্তিপণ আদায়ে অপহরণের জন্য সন্ত্রাসীদের প্রথম লক্ষ্যবস্তু ইয়াবা কারবারি অথবা তাঁদের আত্মীয়স্বজন। পাশাপাশি এলাকার কৃষক, ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীরা অপহরণের শিকার হয়েছেন।
সম্প্রতি কক্সবাজার সফরে এসে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন সাংবাদিকদের বলেন, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ এবং ইয়াবা কারবারিদের আইনের আওতায় আনা গেলে অপহরণসহ নানা অপরাধ বন্ধ হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত সাত মাসে মুক্তিপণের জন্য তিন ইউনিয়নের ৬০ জন স্থানীয় বাসিন্দা ও ১০ জন রোহিঙ্গা কিশোরকে অপহরণ করা  হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৩৯ জনের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে অর্ধকোটি টাকার মুক্তিপণ।

টেকনাফ থানার তথ্যমতে, ২০২২ সালের ১ নভেম্বর থেকে গত ৩০ মে পর্যন্ত সাত মাসে টেকনাফ থানায় অপহরণের মামলা হয়েছে আটটি। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা অন্তত ৫০। এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২০ জনকে। একই সময়ে অপহৃত অনেককে উদ্ধার করেছে পুলিশ।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, টেকনাফে অপহরণ মুক্তিপণ বাণিজ্য বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ জীবনের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে। ফলে সেখানে অনেকে ছেলেমেয়েকে স্কুল-কলেজে পাঠানো নিরাপদ মনে করছেন না।

হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, তাঁর ইউনিয়নের কম্বনিয়াপাড়া মহেশখালিয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া, খারাংখালী, সাতঘড়িয়াপাড়া, রইক্ষ্যম এলাকায় অন্তত ৭০০ পরিবার অপহরণ আতঙ্কে ভুগছে। অতীতে এসব গ্রামের চারজনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছিল।
হ্নীলা ইউপির চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, তাঁর ইউনিয়নের দমদমিয়া, জাদিমোরা, লেদা, আলীখালী, রঙ্গীখালী, পানখালী, কম্মুনিয়াপাড়া ও মরিচ্চ্যঘোনা এলাকার মানুষ অপহরণ আতঙ্কে ভুগছে। এসব এলাকায় মাদক ব্যবসাও বেড়েছে।

এপিবিএন বলছে, গত দেড় বছরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় আড়াইশর বেশি অপহরণ মুক্তিপণের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ক্যাম্পের বাইরে টেকনাফ উপজেলায় দেড়শ ঘটনায় ২০০ মানুষ অপহরণের শিকার হন। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসেন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর অপহরণের ঘটনার সংখ্যা বেশি। তবে পুলিশের খাতায় অপহরণের ঘটনা খুব কম। নাম না বলার শর্তে বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্য বলেন, অপহরণের ভয়ে তাঁর এলাকার লোকজন সন্ধ্যার পরে ঘর থেকে বের হয় না। হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নুরুল হুদা বলেন, অপহরণ আতঙ্কে অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানদের পাঠানো নিরাপদ মনে করছেন না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অনেকটা নিষ্ক্রিয়। তারা অপহরণের অভিযোগ পেলেও দুর্গম পাহাড়ে অভিযানে যেতে চায় না।

টেকনাফ মডেল থানার ওসি আবদুল হালিম বলেন, অধিকাংশ অপহরণের ঘটনা মাদককে ঘিরে হচ্ছে। যাঁরা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসছেন, তাঁদের কেউ থানায় অভিযোগ করছেন না। তাঁদের অনেকের সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী এসব অপহরণের সঙ্গে জড়িত। তবে তাদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু লোকও আছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here