শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে করণীয়-

0
198

বিবেক-জ্ঞান-বুদ্ধি ও মনুষ্যত্বের কারণে মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীব বলা হয়। সততাণ্ডনীতি-নৈতিকতা, দেশপ্রেম, পরোপকার এবং আদর্শ চরিত্রবান মানুষ হওয়ার মূল ভিত্তি সুশিক্ষা। উন্নত জাতি গঠন ও মানবসম্পদ উন্নয়নের গুণগত শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক। স্বামী বিবেকানন্দের মতে, প্রত্যেক শিশুই অনন্ত শক্তির অধিকারী, সেই সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করতে হবে। যে কাজটি শিক্ষক সব বাধা অতিক্রম করে সুনিপুণভাবে সম্পন্ন করেন, যাতে শিশুর জীবন ও চরিত্র গড়ে ওঠে প্রকৃত মানুষ হিসেবে। শিক্ষকই শিক্ষাঙ্গনে ইতিবাচক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথ তৈরি করে দেন।

শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নয়ন ছাড়া কোনো দেশ ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে গেলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত। অভাব শুধু গুণগত বা মানসম্মত শিক্ষার। শিক্ষার মান বাড়বে শিক্ষকদের গুণে। শিক্ষার মান উন্নত করতে শিক্ষকের ভূমিকাই সর্বাধিক অগ্রগণ্য। অভিভাবকদের সচেতন করার দায়িত্বও শিক্ষকদের। শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের জন্য শিক্ষককে আন্তরিক হতে হবে। শিক্ষক দরদি মন নিয়ে শিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষককেই সমাজের পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের আধুনিক পদ্ধতিতে নিয়মিত ও যথাযথ পাঠদান ও শিক্ষাদানের সক্ষমতা, কৌশল ও নৈপুণ্যের ওপর নির্ভর করবে শিক্ষার গুণগত মান ও মানসম্মত শিক্ষা। যেকোনো দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের নিয়মিত, সুষ্ঠু, উন্নত ও পদ্ধতিগত পাঠদান প্রণিধানযোগ্য। শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত আধুনিক সফল, যথাযথ ও নিয়মিত পাঠদান এবং শিক্ষাদান শিক্ষার্থীদের জন্য বড় পাওনা, বড় প্রাপ্তি আর শিক্ষকদের বড় সন্তুষ্টি, বড় সাফল্য, বড় কৃতিত্ব।

শিক্ষকতা অন্যান্য পেশার রোল মডেল। একজন শিক্ষক, সমাজ ও জাতি গড়ার কারিগর। সুস্থ দেশ গড়ার জন্য চাই একজন শিক্ষক। উল্লেখ্য, শিক্ষাব্যবস্থাপনা, শিক্ষা প্রশাসন, যোগ্য শিক্ষকমণ্ডলী ও কারিকুলামের ওপর নির্ভর করে মানসম্মত শিক্ষা অর্জন সম্ভব। শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্তসহ মানসম্মত পাঠদানের অভিনবত্ব সৃষ্টির মাধ্যমেই নিশ্চিত হবে শিক্ষার গুণগত মান। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের পাঠদানের ক্ষেত্রে তাদের সদিচ্ছা, ইচ্ছাশক্তি ও আন্তরিকতাই যথেষ্ট। একজন শিক্ষকের জীবনাদর্শ হবে দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য আলোকবর্তিকাস্বরূপ। শিক্ষকদের স্বশাসিত হতে হবে। তাড়িত হতে হবে বিবেক দ্বারা। শিক্ষার্থীদের আত্মোপলব্ধির প্রয়োজনে চমৎকার উদ্ভাবনী ক্ষমতা থাকবে শিক্ষকদের।

অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষকদের সমন্বয় করা দরকার। শিক্ষার মান উন্নয়নে অভিভাবকদের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি অভিভাবক অন্তত সপ্তাহে এক দিন শিক্ষকদের সম্মানের সাঙ্গে ছাত্রদের বিষয়ে জানতে চাইবেন। শুধু নিজের সন্তানকে সন্তান মনে করলে হবে না। বিদ্যলয়ের প্রত্যেকটি সন্তানকে সমান চোখে দেখা উচিত। নিজের সন্তানকে তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি পাশের অন্যের সন্তানকেও জানতে হবে। শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আপনার সন্তানের পরোক্ষভাবে উপকার হবে। নিজের সন্তানকে শুধু সন্তান মনে করে আমরা একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে গিয়েছি। কেন আমার সন্তান রোল ১ করল না। কেন অমুকের সন্তানের রোল ১ হলো। এতে শিক্ষকরা কিছুটা বিড়ম্বনার স্বীকার হন। তবে এ ক্ষেত্রে যদি শিক্ষকদের কোনো ত্রুটি বা হাত থাকে তাহলে এ লজ্জাজনক কাজ থেকে সরে আসাই ভালো।

শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্যবই পড়ার মধ্যে পাসের সীমাবদ্ধ না রেখে মূল্যবোধ শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, বিনয় ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করার দীক্ষা অবশ্যই আমাদের শিক্ষকদের দিতে হবে। মনে রাখতে হবে শিক্ষক কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, তিনি সমাজেরও শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নির্ভরতা কমিয়ে মানসিক চাপ মুক্ত করতে সহায়তা করা শিক্ষকের একান্ত দায়িত্ব। পরীক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতা হারাচ্ছে। পরীক্ষা নির্ভরতা কমিয়ে, মেধা যাচাই করিয়ে প্রাথমিক স্তরেই ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম, পরোপকারিতা ও ন্যায়পরায়ণতা শেখানো উচিত। আর একটা গুরত্বপূর্ণ বিষয় হলো পরীক্ষার ক্ষেত্রে বারবার নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলে বা নিয়ম চালু হলে তাতে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীর ভূমিকার ব্যাপারে; লেখাপড়ার বিষয়ে কোনো সমস্যা দেখা গেলে তা অবশ্যই শিক্ষকদের জানাতে হবে। দুর্বল শিক্ষার্থী বন্ধুদের প্রতি কখনো খারাপ আচরণ করা যাবে না। তারা যাতে ভালো হয় সেদিকে সাহায্য করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক যাতে সুবিধামতো পড়াতে পারেন সে বিষয়ে শিক্ষককে সহযোগিতা করতে হবে।প্রতিদিনের পড়া প্রতি দিন ক্লাসে শেষ করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা জ্ঞানবৃদ্ধির জন্য সবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তি করা প্রয়োজন। এতে শিক্ষার্থীরা যেমন একটি পরিচ্ছন্ন বিদ্যালয় পাবে, তেমনি তারা কর্মঠ, উদ্যমী ও স্বাবলম্বী হবে এবং পরিচ্ছন্ন থাকার জ্ঞান লাভ করবে। আমাদের শিক্ষার মান উন্নয়নে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সুষ্ঠু শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। শিক্ষা বিষয়ে প্রতিবার বেশি বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। শিক্ষকদের ছাত্র শাসনের ব্যাপারে বিশেষ নিয়মে আবদ্ধ করা যাবে না। সেজন্য শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষকদের কোমলমতি মন নিয়ে ভালোবাসা দিয়ে যতœসহকারে পড়াতে হবে। পাশাপাশি অভিভাবকদের শিক্ষকদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। সবকিছু মিলিয়ে প্রশাসনিক দিক থেকে তৃণমূল পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজালে আমাদের শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব।

আজকের শিশুদের কেউবা হবে আগামী দিনের প্রকৃত মানুষ, আর প্রকৃত মানুষ হতে পারলেই তারা হতে পারবে শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী। কেউ হবে শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, লেখক, কবি ও সাংবাদিক। এগুলো তৈরি হবে শিক্ষাঙ্গনেই। তাই শিক্ষাঙ্গনের শ্রেণিকক্ষই শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্তুতির ক্ষেত্র। পৃথিবীর প্রায় সব দেশই বর্তমান সমাজের প্রয়োজনমতো চাহিদা ও ভবিষ্যৎ সমাজের সম্ভাব্য চিত্রকে সামনে রেখে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা তথা শিক্ষাঙ্গনে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টিতে সচেষ্ট হতে হবে। উত্তম শিক্ষাব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন অনুকূল পরিবেশ। আর এই পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সম্পৃক্ততাই গড়ে দিতে পারে গুণগত শিক্ষার মজবুত ভিত। শিক্ষাকে গুণগত মানের দিক থেকে উন্নত করতে পারলেই জাতীয় জীবনে এগিয়ে চলা সহজ হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here