বর্তমান শিক্ষাদান পদ্ধতিতে শিক্ষকের ভূমিকার ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। একদিকে শিক্ষাদান কাজ যেমন জটিল অন্যদিকে এটি একটি মহান পেশাও বটে।
এই মহান ও জটিল কাজটিকে পেশা হিসাবে নিতে হলে শিক্ষকের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের সমাহার থাকা দরকার, যা তাকে তার দায়িত্ব কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে সহায়তা করবে। নিচে সার্থক শিক্ষকের বৈশিষ্ট্যের ওপর আলােকপাত করা হলাে-
১.সুমধুর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন:
সার্থক শিক্ষক সৌম্য মধুর ব্যক্তিত্বের অধিকারী হবেন। প্রথম দর্শনেই শিক্ষকের যে বৈশিষ্ট্যটি শিক্ষার্থীর মন কাড়ে, তা হলাে তার শান্ত মধুর প্রসন্ন ব্যক্তিত্ব। শিক্ষকের সুমধুর ব্যক্তিত্ব প্রতিটি শিক্ষার্থীর মনে তার প্রতি স্বাভাবিক প্রীতি ও শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়ে তােলে।
২. সুস্বাস্থ্য:
শিক্ষক হবেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। কর্মোদ্যম ও প্রাণময়তা, শান্ত মেজাজ ও পরিমিতিবােধ শিক্ষকতা পেশার জন্য অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। সুস্বাস্থ্য ছাড়া এ গুণগুলির অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়।
৩. প্রেরণা:
উদ্দীপনা সঞ্চারকারী ও সুশিক্ষক শিক্ষার্থীর হৃদয়ে শিক্ষার্জনের অনুকূল প্রেরণা ও উদ্দীপনার কলাকৌশল প্রয়ােগে সুনিপুণ হবেন। নিরানন্দ শিক্ষাদান ও কৃত্রিম নিয়ম-শৃঙ্খলা শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক বিকাশের পরিপন্থী। কাজেই শিক্ষককে এমন সব কৌশলের চর্চা করতে হবে যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাঠে মনযােগী হবে।
৪. নবীন মানস:
শিক্ষকের স্বাভাবিক সহজতাই তাকে রাখে কর্মময়, চির নবীন ও প্রাণবন্ত। নবীন মনই তাকে শিক্ষার্থীদের প্রতি অনুরাগী করে তােলে। অনুরাগের প্রতিফলনে তিনি শিক্ষার্থীদের আপনজন হওয়ার যােগ্যতা, অধিকার ও গৌরব লাভ করেন।
৫. শিশুরঞ্জন মানসিকতাসম্পন্ন:
স্বার্থক শিক্ষক হবেন শিশুরঞ্জন মনের অধিকারী শিশুকে ভাল না বাসলে তিনি শিশুর সজীব মনের ইচ্ছা, অনিচ্ছা, স্বপ্ন-সাধ, আশা আকাক্ষা, আনন্দ বেদনা, অনুরাগ অভিমান সম্পর্কে জানতে পারবেন না । রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “কী শিখাব, তা ভাববার কথা বটে; কিন্তু যাকে শিখাব তার সমস্ত মনটা কী করে পাওয়া যেতে পারে, সেটাও কম কথা নহে।”
শিক্ষকের সুমধুর মনােভঙ্গি, সহজ প্রসন্নতা, সাহায্যদানের সদিচ্ছা অতি সহজেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে ঘিরে প্রীতিময় পরিমণ্ডল রচনা করে এবং এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্জন অনায়াস, আনন্দময় এবং অর্থবহ হয়ে ওঠে।
৬. মৌলিকতা:
মৌলিকতা সুশিক্ষকের একটি মূল্যবান সম্পদ। তার পরিচয়ের স্বাক্ষর বহন করে তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। বিদ্যালয়ের মতাে শিক্ষামূলক সামাজিক প্রতিষ্ঠানে মৌলিক গুণসম্পন্ন শিক্ষকের প্রয়ােজনীয়তা এবং তার গুণের প্রয়ােগ অপরিহার্য।
৭. নমনীয়তা:
চিত্তের প্রসার ও নমনীয়তা শিক্ষককে বিচিত্র ধরনের মানুষের মধ্যেও বিবিধ পরিবেশে সামঞ্জস্য বিধানের দক্ষতা দান করে। এর উৎস হচ্ছে অহং শূন্যতা। মানিয়ে চলবার ক্ষমতার সঙ্গে অন্তরে যে সহানুভূতি, সহৃদয়তা এবং নমনীয়তার স্পর্শ থাকে, তার মূলে থাকে অহংশূন্যতার অকপট গুণটি।
সহ্যশক্তি, ক্ষমাগুণ এবং সহজাত প্রসন্নতা ব্যতীত গ্রহণশীলতার দুর্লভ ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব নয়। এই ক্ষমতা শিক্ষককে একাধারে বিচিত্র এবং বিরূদ্ধ প্রকৃতির শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সংশ্লিষ্ট কর্মীদের নিয়ে একই সাথে একই লক্ষ্যে চলবার সামর্থ্য যােগায়।
৮. চাহনী ও বাকশৈলী:
সুশিক্ষকের শিক্ষণকর্মের দুটি চমৎকার কলাকৌশল হলাে চাহনী ও বাকশৈলী। একটি অস্ফুট অপরটি ফুট। চোখের চাহনী অস্ফুট হলেও ক্ষেত্র বিশেষে এটি বাকভঙ্গিকেও গৌণ করে দিতে পারে।
বিস্ময়কর শব্দ চেতনা, প্রচুর শব্দ ভাণ্ডার বাক চাতুর্য এবং শব্দ ও বাক্য প্রয়ােগে প্রয়ােজনানুগ সংকোচন প্রসারণ, উচ্চ- নিচ স্বর ও সংযম শিক্ষকের প্রকাশ ভঙ্গিকে সংবেদনশীল, মনােজ্ঞ ও অর্থবহ করে তােলে।
৯. রসিকতা বােধ:
সুশিক্ষক অবশ্যই হবেন সুরসিক। তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আনন্দ বিতরণ করবেন, তাদের আনন্দের অংশীদার হবেন কিন্তু আনন্দের উপলক্ষ হয়ে ক্রমশ তামাশার কারণ হবেন না। পাঠদানে সময়ােচিত রস কৌতুকের স্নিগ্ধ আমেজ ও মধুর সম্পর্ক অনুভূত হলে শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ গ্রহণ হবে স্বচ্ছন্দ।
১০. দৃঢ় মানসিকতা:
প্রত্যয় দৃঢ় মানসিকতা উত্তম শিক্ষকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিটি কথায় ও কাজে, পােশাক ও রুচিতে, পেশায় ও কর্তব্য পালনে তিনি আদর্শবান, ধর্মপ্রাণ, সত্যপ্রিয় ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেবেন। কেবলমাত্র আদেশ উপদেশ নয়, শিক্ষক নিজের অভ্যাস, অনুশীলন এবং জ্ঞান অভিজ্ঞতায় লব্ধ বিচিত্র কর্মের মাধ্যমে ছাত্রদের চরিত্রে বাঞ্ছিত পরিবর্তন সাধনে উদ্যোগী হবেন।
১১. উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা:
শিক্ষকের অতি বড় হাতিয়ার হলাে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব বা উপস্থিত বুদ্ধি। বিদ্যালয়ের যে কোন আকস্মিক সমস্যার তাৎক্ষণিক মােকাবেলার জন্য অতি দ্রুত একটি বৌদ্ধিক ও যৌক্তিক সমাধানে পৌছাতে হয়। পরিবেশ পরিস্থিতির সংগে খাপ খাইয়ে যতদূর সম্ভব সৃষ্ট কোন সমস্যার দ্রুত সুরাহার উপযােগী একমাত্র বর্ম উপস্থিত বুদ্ধি।
১২. মার্জিত পােষাক:
আদর্শবান শিক্ষকের ব্যক্তিত্বের ভূষণ হলাে সুমার্জিত আচার আচরণ এবং পরিপাটি পােশাক। আড়ম্বরের বাহুল্য আসল মানুষের ব্যক্তিত্বকে কৃত্রিম আবরণে ঢেকে রাখে। শিক্ষকের কাজ সহজকে নিয়ে সহজ হওয়ায়। তার জীবনাদর্শ সহজ জীবন ও মহৎ ভাবনা হওয়াই কাম্য।
উক্ত গুণগুলি শিক্ষক তার সহজাত এবং অর্জিত জ্ঞান অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে আয়ত্ত করবেন। নিজ পেশায় অনুরাগ ও অধিকারে ব্রতী শিক্ষক অনেক গুণই অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন করতে পারেন। এছাড়াও নিম্নবর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলি অর্জনে তার ধী, মেধা, প্রবণতা এবং নৈপুণ্যের প্রয়ােগ করবেন। যেমনঃ
১. নেতৃত্বদান:
সুশিক্ষক অবশ্যই তার আচার আচরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর আস্থা, শ্রদ্ধা এবং সহৃদয় সহযােগিতা লাভ করতে প্রয়াসী হবেন। অন্যথায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষার লক্ষ্যপথে চালাতে তথা তাদের আচার আচরণে বাঞ্ছিত পরিবর্তন সাধনে শিক্ষক নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেন।
২. উদ্যমশীলতা:
শিক্ষক আত্মপ্রত্যয়শীল ও সক্রিয় হবেন। নিরুদ্যম, নিঃস্পৃহ শিক্ষক কখনাে সফল হতে পারেন না।
৩. সামাজিকতাবােধ:
শিক্ষককে শ্রেণী শিক্ষাদানে বা শ্রেণীর বাইরে সমাজের একটি ক্ষুদ্রাংশ নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করতে হয়। এদের প্রতি দায়িত্ব পালনে শিক্ষককে শিক্ষার আদর্শ সমাজের আদর্শ, শিক্ষার্থী ও সমাজের চাহিদা ইত্যাদি বিচার বিবেচনা করে তার নিজ কর্তব্য সম্পন্ন করতে হয়।
তাই তাকে সমাজ সেবার মনােভাব নিয়ে সমাজের চাহিদা পরিপূরণের বিশেষ ভূমিকা পালন করার উপযােগী হতে হবে।
৪.মুদ্রাদোষমুক্ত:
শিক্ষককে সকল মুদ্রাদোষ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। শৈশব, বাল্য ও কৈশােরকাল হলাে অনুকরণ ও অনুশীলনের সময়। শিক্ষকের মুদ্রাদোষ স্বভাবতই শিক্ষার্থীর ওপর প্রভাব ফেলে। তাই শিক্ষকের মুদ্রাদোষ থাকা অনুচিত।
৫.অধ্যয়নশীল:
সুশিক্ষকের সাধনাই হচ্ছে সারাজীবন ছাত্র থাকার মানসিকতা পােষণ করা। শিক্ষার্জনের পথ কেবল ডিগ্রিপ্রাপ্তি বা পুঁথি সর্বস্ব জ্ঞানের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষা একটি পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। এই পরিবর্তনের সংগে মনমানসিকতাকে সজীব রাখার জন্য শিক্ষা ক্রিয়ার অপরিহার্য উপাদান শিক্ষককে অধ্যয়নের মাধ্যমে সজীব ভাবনা ও নতুনতর দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হতে হবে।
৬. শিখন পদ্ধতি সংক্রান্ত জ্ঞান:
শিক্ষক কেবল জ্ঞান সমৃদ্ধই হবেন না, শিক্ষার্থীর মনে জ্ঞান প্রয়ােগের মূল সূত্রটি তিনিই ধরিয়ে দেবেন। এজন্যই শিক্ষণীয় বিষয়ের জ্ঞান, বিষয়সম্পৃক্ত অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞান এবং শিক্ষাবিজ্ঞান সম্পর্কে তার ধ্যান ধারণা থাকতে হবে। শিক্ষককে আধুনিকতম শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং বাস্তব ক্ষেত্রে জ্ঞান প্রয়ােগের প্রয়ােগ কৌশল বিশেষভাবে আয়ত্ত করতে হবে।
৭. আত্মমূল্যায়ন:
অবিরত আত্মসমীক্ষা ও আত্মমূল্যায়ন করা নিজ পেশায় নিষ্ঠ শিক্ষকের রক্ষাকবচ। মানুষ দোষমুক্ত নয়, সমালােচনা বহির্ভূত নয়। আত্ম সমালােচনা নিজের চিন্তা ও কর্মের পথকে পরিশীলিত করে আত্মমর্যাদা রক্ষা করতে সাহায্য করে।
শিক্ষক হিসেবে সফল তথা শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষককে উপরােক্ত বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলির চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে।