চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি

0
400

চ্যালেঞ্জর মুখে পড়েছে বাংলাদেশের  জনশক্তি রপ্তানি। যেসব দেশে বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি করে সেসব দেশ অর্থনৈতিক সংকটে কর্মী নেওয়া বন্ধ বা কমিয়ে দিয়েছে। এর বাইরে সেসব দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় কর্মরত কর্মীরা দেশে অর্থ প্রেরণের পরিমাণও কমিয়ে দিচ্ছেন। সামনের দিনগুলোতে অর্থ প্রেরণের পরিমাণ আরো কমবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। মূলত জনশক্তি রপ্তানিতে কয়েকটি দেশের ওপর নির্ভরতা এবং পুরোনো কয়েকটি শ্রমবাজারে কর্মীর চাহিদা না থাকায় পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে বলে অনেকের অভিমত দেন।

জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, পুরোনো শ্রমবাজারগুলোতে কর্মী প্রেরণের হার ক্রমেই কমে আসছে। লিবিয়া, কুয়েত, ইরাক প্রভৃতি দেশে কর্মী প্রেরণ একেবারে বন্ধ বললেই চলে। এ অবস্থায় নতুন বাজার খোঁজা ছাড়া আমাদের সামনে কোনো বিকল্প  পথ নেই। জাপান, কোরিয়া এবং ইউরোপের দেশগুলোতে মাইগ্রেশন কূটনীতি বাড়িয়ে এ বাজারগুলো অনুকূলে আনা যায়।

বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে জনশক্তি রপ্তানি হয় সেসব দেশে বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। এরপরও জনশক্তি রপ্তানিতে বিশেষ কয়েকটি দেশের ওপর বাংলাদেশকে নির্ভর করতে হয়। এর মধ্যে সৌদি আরব অন্যতম। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, ১৯৭৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ যে জনশক্তি রপ্তানি করেছে তার ৩৩ শতাংশের বেশি গেছে সৌদি আরবে। এই হার দিন দিন বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি দেশের ওপর অতি নির্ভরতা বাংলাদেশকে বিপদে ফেলতে পারে। সৌদি আরবে কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা রয়েছে উল্লেখ করে তারা বলেন, গত দুই বছরে দেশটিতে কর্মী প্রেরণে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা। দেশটি থেকে কর্মী নেওয়ার চাহিদা নিয়মিত এলেও সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের নানা ধরনের অসহযোগিতা রয়েছে। অপরদিকে, কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে যে খরচ সেটিও আগের চেয়ে বেড়েছে।

এ কারণে স্বল্প বেতনের কর্মীরা আর সেখানে যেতে চাচ্ছেন না। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, একসময় বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে প্রচুর মহিলা কর্মী গেছেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে নানা অপপ্রচারের কারণে মহিলা কর্মীরা অনেকেই সেখানে যেতে উত্সাহী নন। এর ফলে কর্মী প্রেরণের সংখ্যা মোটের ওপর যেমন কমেছে, সঙ্গে সঙ্গে রেমিট্যান্সেও এর প্রভাব পড়েছে। পুরোনো বাজার নতুন করে খোলার উদ্যোগ নেই

একসময় বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে জনশক্তি রপ্তানি হতো তার অনেক দেশেই এখন তা বন্ধ আছে। এসব বাজারে নতুন করে জনশক্তি রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেই। রপ্তানিকারকরা জানান, অনেক দেশে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিলে বাজার খুলতে পারত। বেসরকারি খাতের উদ্যোগ এখানে সামান্য কাজ করে। লিবিয়া, কুয়েত, ইরাক, জর্ডান প্রভৃতি দেশে জনশক্তি রপ্তানি একপ্রকার বন্ধ। অথচ একসময় এসব দেশে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি হতো উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। বিএমইটির হিসেবে দেখা যায়, ২০২১ সালে লিবিয়াতে মাত্র তিন জন কর্মী বাংলাদেশ থেকে গিয়েছে। এসময় কুয়েতে গেছে মাত্র ১ হাজার ৮০০ কর্মী। ইরাকে পাঁচ জন কর্মী চাকরি নিয়ে গেছেন। জর্ডানেও কর্মী যাওয়া কমেছে। অথচ একসময় এসব দেশে বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মী গিয়েছে।

শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া এবং ইউরোপের দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানি তেমন উল্লেখ করার মতো নয়। জাপানের সঙ্গে এ বিষয়ে সরকারের চুক্তি হলেও এ পর্যন্ত মাত্র ৭০০ থেকে ৮০০ কর্মী সেখানে গিয়েছে। অথচ দেশটিতে কর্মী প্রেরণের জন্য ৭০টি রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতিটি ৩০ লাখ টাকা করে সরকারকে জমা দিয়েছে। দেশটির কৃষিখাতে কাজ করার জন্য নেপাল থেকে কর্মী গেলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অবহেলিত। দক্ষিণ কোরিয়ায় একসময় বাংলাদেশি জনশক্তি প্রচুর গেলেও এখন তা একেবারেই নগণ্য। মালয়েশিয়ায় নানা উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশের জন্য শ্রমবাজার উম্মুক্ত হলেও আশাতীত সফলতা মিলছে না। এখন পর্যন্ত মাত্র ৫ হাজারের বেশি শ্রমিক দেশটিতে গেছেন। ওয়াকিবহাল সূত্র বলছে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যে গতি আসার কথা সেভাবে গতি ফেরেনি। বিশেষ করে দেশটিতে সামনের সাধারণ নির্বাচনকে ঘিরে জনশক্তি আমদানিকারকরা একটু সময় নিতে চাইছেন। আশা করা যাচ্ছে, নির্বাচনের পর কর্মী যাবার ক্ষেত্রে গতি আসবে। এবছর এবং আগামী বছরের মধ্যে যদি ৪ থেকে ৫ লাখ কর্মী প্রেরণ করা যায় তাহলে বাংলাদেশ একটি টার্গেট পূরণ করবে। ইউরোপের বাজারেও বাংলাদেশের শ্রমবাজার খুব দুরাবস্থার মধ্যে। একমাত্র ইটালিতে কিছু কর্মী গেলেও বাকি দেশগুলোতে কোনো আশার আলো নেই।

বিদেশে কর্মী প্রেরণের হার কমে গেলে প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ বা রেমিট্যান্সে চাপ পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতিমধ্যে সে চাপ পড়তে শুরু করেছে বলে অভিমত তাদের। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। প্রবাসী আয়ের এই অঙ্ক গত সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ১৪৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। গত আগস্ট মাসে ২০৩ কোটি ৭৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। তার আগের মাসে জুলাইয়ে এসেছে ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। এর আগে প্রতি বছর রেমিট্যান্স প্রেরণের হার বাড়লেও এই প্রথম তা কমতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুাযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ ডলার। তার আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছে ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছে ১ হাজার ৮২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছর এসেছে ১ হাজার ৬৪১ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ হাজার ৪৯৮ কোটি ১৭ লাখ ডলার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু কর্মী প্রেরণের কারণে রেমিট্যান্স কমেছে তা নয়, কর্মীরা যারা সেখানে কাজ করেন তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তারা দেশে অর্থ কম পাঠাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে খবর নিয়ে জানা গেছে, তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় অন্তত ৩০ শতাংশ বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সের ওপর।

জনশক্তি রপ্তানির গতি প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞ হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরন। ইত্তেফাককে তিনি বলেন, ট্র্যাডিশনাল শ্রমবাজারগুলোতে আমাদের জনশক্তি একবারে বন্ধ বললেই চলে। বিশেষ করে লিবিয়া, ইরাক, কুয়েত এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে অনেক দিন ধরেই শ্রমশক্তি রপ্তানি বন্ধ। তাছাড়া জাপান আমাদের জন্য একটি বড় বাজার হতে পারত। সেখানে জনশক্তি রপ্তানির জন্য ৭০টি রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। কিন্তু তেমন সফলতা আসেনি। দেশটিতে নেপাল জনশক্তি রপ্তানি করলেও আমরা পারছি না। তিনি বলেন, অনেক চেষ্টার ফলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুললেও সেখানকার ফলাফলও আশাপ্রদ নয়। দেশটির সামনের নির্বাচনকে ঘিরে চাকরিদাতারা কিছুটা সময় নিচ্ছেন। তবে তিনি জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে দক্ষতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, দক্ষ কর্মী প্রেরণ করা না গেলে আমরা অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারব না। তবে, এক্ষেত্রে সরকারের অভিবাসন কূটনীতি জোরদার করারও আহ্বান জানান তিনি। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবার ফলে শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহে খরচ বেড়েছে। এজন্য অর্থ প্রেরণের হারও কমেছে। সামনের দিনগুলোতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here