দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এখনো ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার বিক্রি অব্যাহত থাকায় রিজার্ভের পরিমাণ আরো কমেছে। ১৯ জুলাই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি (বিপিএম৬) অনুযায়ী, রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ তথ্য প্রকাশ করে।
এক সপ্তাহ আগে ১২ জুলাই বিপিএম৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার ছিল। গত এক সপ্তাহে দেশের গ্রস রিজার্ভে ১২ কোটি ২৮ লাখ ডলার ক্ষয় হয়েছে। আর চলতি মাসের এখন পর্যন্ত রিজার্ভের ক্ষয় ১৩৫ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবারও রিজার্ভ থেকে ৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার ও ২০ লাখ ইউরো বিক্রি করা হয়েছে। রোববার বৈদেশিক লেনদেন বন্ধ থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রিও বন্ধ ছিল। তবে আজ আবারো রিজার্ভ থেকে বড় অংকের ডলার বিক্রি করতে হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলোয় এখনো ডলারের সংকট কমেনি। প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কেনার বিপুল চাহিদা আসছে। কোনো কোনো দিন এ চাহিদার পরিমাণ ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকৃত চাহিদা যাছাই করে তবেই ডলার বিক্রি করছে। বাকি ডলার বাজার থেকে কেনার জন্য বলা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে জ্বালানি তেল, এলএনজি, সারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির দায় মেটানোর জন্য। পাশাপাশি সরকারের বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্যও ডলার বিক্রি করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে রেকর্ড সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
চলতি মাসের শুরু থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফ থেকে ঋণ প্রাপ্তির শর্ত হিসেবে এর বাস্তবায়ন শুরু হয়। ২০১২ সাল থেকে আইএমএফের সদস্য দেশগুলো ব্যালান্স অব পেমেন্টস এবং ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম৬) অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাবায়ন করে আসছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তা শুরু করতে প্রায় এক যুগ সময় নিয়েছে। বিপিএম৬ মূলনীতি অনুযায়ী, হিসাব করা রিজার্ভও বাংলাদেশের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ নয়। নিট রিজার্ভ হিসাবায়নের ক্ষেত্রে আইএমএফ থেকে নেয়া এসডিআরসহ স্বল্পমেয়াদি বেশকিছু দায় বাদ দেয়া হয়। সে হিসাবে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভের পরিমাণ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
ডলার সংকট কাটাতে আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণপ্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার ছাড় দিয়েছে সংস্থাটি। তবে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে বেশকিছু শর্ত পরিপালন করতে হবে বাংলাদেশকে। এর মধ্যে অন্যতম শর্ত হলো ৩০ জুনের মধ্যে বিপিএম৬ মূলনীতি অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের এ শর্ত পরিপালন করতে পেরেছে বলে জানা গেছে। তবে এজন্য জুনের শেষ সপ্তাহে বাজার থেকে ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ৩০ জুন বিপিএম৬ মূলনীতি অনুযায়ী দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করা হয়। এতে বিপিএম৬ মূলনীতি অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ ২৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিসংখ্যান নিয়ে অনেক আগে থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছে আইএমএফ। সংস্থাটির সুপারিশ ছিল, রিজার্ভের হিসাবায়ন করতে হবে বিপিএম৬ মূলনীতি অনুসরণ করে। এক্ষেত্রে রফতানি উন্নয়ন তহবিলসহ (ইডিএফ) বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে বাদ দিতে হবে। আইএমএফের শর্ত মেনেই শেষ পর্যন্ত গতকাল রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করা হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ৭ বিলিয়ন ডলারের ইডিএফ এখন ৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। এ কারণে আইএমএফের শর্ত পূরণ করা কিছুটা সহজ হয়েছে। বিপিএম৬ মূলনীতি অনুযায়ী হিসাবায়নের ক্ষেত্রে রিজার্ভের অর্থে গঠন করা গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ডে (জিটিএফ) ২০ কোটি, লং টার্ম ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) তহবিলে ৩ কোটি ৮৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে দেয়া ৬৪ কোটি ডলার ও বাংলাদেশ বিমানকে দেয়া ৪ কোটি ৮০ লাখ এবং শ্রীলংকাকে ২০ কোটি ডলারসহ মোট ৬৪০ কোটি ডলার বাদ দেয়া হয়েছে।
দুই দশক ধরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। ২০১৬ সালের ৩০ জুন রিজার্ভের গ্রস পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। এরপর ২০১৯ সালের শেষ পর্যন্ত রিজার্ভ ছিল কিছুটা স্থিতিশীল। ২০২০ সালে কভিড-১৯-এর প্রভাবে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়। রিজার্ভের পরিমাণও দ্রুতগতিতে বেড়ে যায়। ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। এর পর থেকে রিজার্ভের অস্বাভাবিক ক্ষয় অব্যাহত রয়েছে।