‘ওয়েটার’ থেকে কোটি টাকার মালিক শিবচরের নাসির কাজী!

0
64

মাদারীপুর: পদ্মা সেতু প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে মাদারীপুর জেলার শিবচরে শূন্য থেকে কোটিপতি হয়েছেন অনেকেই। মাদারীপুর জেলা প্রশাসন থেকে এরকম ২০ জন ব্যক্তির (দালাল) একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে।

অভিযুক্ত দালালদের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্প থেকে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।  

দালালদের অনুসন্ধানের জন্য তালিকা ইতোমধ্যেই দুদকে পাঠিয়েছে প্রশাসন। এই ২০ দালালের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন জেলার শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের নাসির উদ্দিন কাজী (কেএম নাসির)।  

দত্তপাড়া ইউনিয়নের গুপ্তেরচর এলাকার পশু চিকিৎসক কাজী মোজাম্মেল হকের ছেলে তিনি। ঢাকার একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে দীর্ঘদিন ‘ওয়েটার’ এর কাজ করেছেন এই নাসির। পরে বাড়ি এসে বাবাকে পশু চিকিৎসার কাজে সাহায্য করতেন।  

অভিযোগ রয়েছে, পদ্মা সেতুর জমি অধিগ্রহণের কাজে দালালি এবং শিবচরের ১০ থেকে ১৫টি মৌজায় পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ হওয়া জমির ক্ষতিপূরণের বিল নামে-বেনামে নানান উপায়ে প্রায় ২০০ কোটি টাকা উত্তোলন করে নিয়েছেন নাসিরসহ একটি দালাল চক্র। সরকারি জমির ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দেখিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা তুলে নেয় এই চক্রটি। জেলা প্রশাসনের তৈরি করা ২০ দালালের প্রায় প্রত্যেকেরই রয়েছে আলিশান বাড়ি, নগদ অর্থ এবং জমিসহ নানান সম্পত্তি।

জানা গেছে, শিবচরের ডাইয়ারচর মৌজায় পদ্মা সেতুর রেল লাইনে ক্ষতিগ্রস্ত হারুন ব্যাপারী, তার স্ত্রী নুরুন্নাহার বেগম ও ছেলে মেহেরাব হোসেনসহ পার্শ্ববর্তীরা দোকানঘর ও জমির  জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৪ ধারা, ৭ ধারা ও ৮ ধারা নোটিশ পান। তবে নোটিশ পেয়ে ডিসি অফিসে বারবার ঘুরেও বিল পাচ্ছিলেন না তারা। দীর্ঘ চেষ্টার পর ক্ষতিগ্রস্তরা জানতে পারেন ওই দাগগুলো থেকে ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে তুলে নিয়ে গেছে দালালরা। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় এই ভুয়া বিল ওঠানোর অভিযোগে শাহীন ব্যাপারী নামে এক দালালকে আটক করে পুলিশ।  

তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি মামলায় আসামি হয় জেলা প্রশাসনের তালিকাভুক্ত শীর্ষ দালাল নাসির কাজী, তার দুই মামা ও এক নিকটাত্মীয়। আসামিদের কেউ ওই এলাকার বাসিন্দা না হওয়া সত্ত্বেও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক শ্রেণীর কর্মচারীর সহায়তায় এ দফায় প্রায় দুই কোটি টাকা লোপাট হয়। গ্রেপ্তারকৃত শাহীনের পরিবার (দালাল নাসিরের সহযোগী) আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়। শাহীনের নামে প্রায় দুই কোটি টাকার বিল ছাড় হলেও লোপাটকৃত টাকার মাত্র ২০ লাখ টাকা ভাগ পায় তারা। বাকি টাকা নেয় নাসিরসহ অফিসের লোকজন। দালাল চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে টাকার লোভ দেখিয়ে তাদের নামে ভুয়া কাগজ তৈরি করে সরকারি অর্থ হাতিয়ে নিত। যাদের নামে চেক ইস্যু করা হয়েছে, তাদের ব্যাংক একাউন্টে জালিয়াতি করে নেওয়া সরকারি টাকা জমা হওয়ার পর সেই টাকা চলে যেত মূল দালাল কেএম নাসিরের (নাসির কাজী) একাউন্টে।  

দালাল নাসির কাজীসহ চক্রটি শিবচরের পাঁচ্চরের ডাইয়ারচর, পাঁচ্চর, সতেররশি, কেরানিবাট, বড় বাহাদুরপুর, গুয়াতলা, নলগোড়া, দক্ষিণ চরজানাজাত, গুপ্তেরকান্দি এবং মাগুরখণ্ড মৌজার বিভিন্ন জমি থেকে জালিয়াতি করে ক্ষতিপূরণ হিসেবে চেকের মাধ্যমে সরকারি প্রায় ২শ কোটি টাকা উত্তোলন করে নেয়! আর এই দালালচক্রের সব চেকের টাকা উত্তোলন করা ব্যক্তির শনাক্তকারী হয়েছেন শিবচরের দত্তপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সুধাংশু কুমার মণ্ডল। সুধাংশু কুমার মণ্ডল এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলও খেটেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হলে নাসির কাজী শুরু করেন দালালি। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সহায়তায় অন্যের জমির অধিগ্রহণকৃত বিল ছাড়িয়ে আনা, অবকাঠামোর ক্ষতিপূরণের বিল কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে দালালি করতে করতে এক পর্যায়ে মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। এরপর গড়ে তোলেন দালাল সিন্ডিকেট। অন্যের জমির বিল তুলে আনাসহ সরকারি খাস জমি বিভিন্ন মানুষের নামে ভুয়া কাগজ তৈরি করে সরকারের কোটি কোটি টাকা উত্তোলন করতে থাকেন।  

ভুক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্ত হারুন ব্যাপারী বলেন, আমাদের জমির সব কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও অন্য এলাকার বাসিন্দা দালাল নাসির, শাহীনসহ দালাল চক্র ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ডিসি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় জালিয়াতির মাধ্যমে বিলের প্রায় ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা উত্তোলন করে নিয়ে গেছে। এই অঞ্চলে এদের কোনো জমি নেই। যার কারণে আমরা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ক্ষতিপূরণের টাকা এখনো পাইনি।  

আরেক ভুক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্ত খোকন সিকদার বলেন, ডিসি অফিসের এলএ শাখার সাবেক সার্ভেয়ার রাসেল ও মোস্তাফিজুর রহমান (বর্তমানে চাকরিচ্যুত) কারসাজি করে দালাল নাসিরের সহযোগী গ্রেপ্তারকৃত শাহীনের নামে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে দিয়ে আমাদের জমির ক্ষতিপূরণের প্রায় ২ কোটি ৫২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দালাল চক্রটি। চক্রটি এছাড়াও ভিপি ও খাস খতিয়ানের কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শুধু ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে।  

গ্রেপ্তারকৃত শাহীন বেপারির ছেলে জালাল ব্যাপারী বলেন, দালাল নাসির, আলিউজ্জমান, আক্তারজামানসহ ওরা কয়েকজন মিলে আমার বাবাকে দিয়ে টাকা উত্তোলনের এই কাজটি করিয়েছে। জাল কাগজপত্র তৈরি করেছে নাসিরের মামা আক্তারুজ্জামান। আমার বাবার ব্যাংক একাউন্টে ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা এলে নাসির, আক্তারুজ্জামানরা তাকে ভয় দেখিয়ে দুই চেকের মাধ্যমে সব টাকা ওদের একটি একাউন্টে ট্রান্সফার করে নেয়। এর থেকে বাবাকে ২০ লাখ টাকা দেয়। এত বড় ঘটনা বাবা আমাদের পরিবারের কাউকেই বলেনি। এত বড় ঘটনায় যারা মূলহোতা তাদের এখনো পুলিশ ধরতে পারেনি। তার মধ্যে আক্তারুজ্জামান আর আরেকজন জামিনও পেয়ে গেছে।  

গ্রেপ্তারকৃত ইউপি সদস্য সুধাংশ মণ্ডল (নাসিরের সহযোগী) বলেন, ‘কোনো জমির মালিক আছে আবার কোনো জমির মালিক নেই এ সব ফাঁক ফোকর তো কানুন ছাড়া আর কেউ জানে না। ডিসি অফিসের এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দালাল নাসিরের সঙ্গে যোগাযোগ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি হলে হিন্দু ধর্মের লোক, জেলেদের জমি হলে জেলে সম্প্রদায়ের লোক সেট করে শুধুমাত্র আইডি কার্ড নিয়ে বাকি জমির সব কাগজপত্র জাল দলিল তৈরি করে ওরা ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলন করেছে।  

আমার ধারণা নাসির কাজী, মতিউর কাজী, নাসিরের দুই মামাসহ চক্রটি প্রায় ২শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আমার জানামতে নাসির কাজী কক্সবাজারে দশতলা একটি হোটেল করেছে, গুলশানে একটি ফ্ল্যাট কিনেছে। ’

অভিযুক্ত নাসিরের বাবা কাজী মোজাম্মেল হক বলেন, ‘নাসিরের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সে কোথায় আছে বা কি করে তা কিছুই জানিনা। ’ 

মাদারীপুর পুলিশ সুপার মো. মাসুদ আলম বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের ঘটনায় যারাই জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে মামলাটি আমরা অতি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। এটার সঙ্গে যারা জড়িত তারা যত ক্ষমতাশালী হোক আমরা তাদের কোনো ছাড় দেব না। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসবো।

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মারুফুর রশিদ খান বলেন, ‘আমরা অভিযুক্ত ব্যক্তি ও দালালদের ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নিতে দুদক ও পুলিশ সুপারকে অনুরোধ করেছি। এখন ব্যাপারটি তদন্ত করে পুলিশ ও আইন আদালত ব্যবস্থা নেবে। আগে দালাল সিন্ডিকেট যে সব অনিয়ম করেছে বর্তমানে আর তা সম্ভব না। এখন আর ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় কোনো অনিয়মের সুযোগ নেই। ’

উল্লেখ্য, ভূমি অধিগ্রহণের এই কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত থাকায় ইতোমধ্যে মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার তৎকালীন সার্ভেয়ার রাসেল আহমেদ এবং মোস্তাফিজুর রহমানকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এছাড়াও এলএ শাখার তৎকালীন সার্ভেয়ার মাইনুল হাসান ও শিবচরের কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের সাবেক তহশিলদার মাহমুদ বেপারীর (সাময়িক বহিষ্কার) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে প্রশাসন।

এদিকে জেলা প্রশাসনের তালিকাভুক্ত ২০ দালালের মধ্যে জাজিরা উপজেলার বিকে নগর এলাকার হুমায়ুন ঢালীকে বুধবার (১৬ আগস্ট) গ্রেপ্তার করেছে মাদারীপুর গোয়েন্দা পুলিশ।  

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here