ডিজিটাল ব্যাংকের সাত-পাঁচ

0
80

সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবাকে আরও প্রযুক্তিনির্ভর করতে এবং নগদবিহীন লেনদেনকে উৎসাহিত করতে দেশে চালু হতে যাচ্ছে ডিজিটাল ব্যাংকিং। যেহেতু তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রযুক্তির ব্যবহার বেশ জনপ্রিয় তাই আশা করা যায়, ডিজিটাল ব্যাংকিং বেশ দ্রুতই আমাদের দেশ সমাদৃত হবে। প্রচলিত স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করেই ব্যাংকিং সুবিধা পাওয়া যাবে এই পদ্ধতিতে। সরাসরি কাউন্টারে না গিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সহায়তায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করাকেই ডিজিটাল ব্যাংকিং নামে আখ্যায়িত করা হয়। যদিও ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে প্রচলিত ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইন্টারনেট/অনলাইন ব্যাংকিং, কিউ আর কোড ব্যবহার করে কেনাকাটা, পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস) মেশিনে কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটা, এটিএম (অটোমেটেড টেলার মেশিন) সেবা, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড সেবা, মোবাইল ব্যাংকিং, এসএমএস (শর্ট মেসেজ সার্ভিস) সেবা ইত্যাদি। ডিজিটাল ব্যাংক শুধু মোবাইল, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করেই করা যাবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের জন্য পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রকাশ করেছে। ইতিমধ্যে জানা গেছে, ৫২টি প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে আবেদন করেছে। আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মোবাইল আর্থিক সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি স্টার্টআপ কোম্পানি, মোবাইল অপারেটর, গ্যাস পাম্প কোম্পানি, ওষুধ কোম্পানি ইত্যাদি রয়েছে। ডিজিটাল ব্যাংক করার জন্য বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠিত ১০টি ব্যাংক একটি জোট বা কনসোর্টিয়াম গঠন করেছে সেগুলো হচ্ছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড, দি সিটি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক। ডিজিটাল ব্যাংক গঠনে ১০ ব্যাংকের প্রতিটি প্রায় ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা করে মোট ১২৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেবে। ব্যাংকটির নাম প্রস্তাব করা হচ্ছে ‘ডিজি ১০ ব্যাংক পিএলসি’।ডিজিটাল ব্যাংকের কোনো শাখা, উপশাখা, এটিএম বুথ বা সশরীরে লেনদেনের কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। প্রচলিত অনেক ব্যাংকেও এখন টাকা লেনদেন, হিসাব দেখার মতো কিছু সেবায় ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু নতুন এই ব্যাংকের সব কাজ হবে প্রযুক্তিনির্ভর। অ্যাকাউন্ট খোলা, আমানত গ্রহণ, ঋণ প্রদান থেকে শুরু করে যাবতীয় ব্যাংকিং সেবা দিবে এই ডিজিটাল ব্যাংক। বর্তমানে দেশে প্রচলিত ধারার ব্যাংক রয়েছে মোট ৬১টি। শাখার পাশাপাশি এসব অনেক ব্যাংকের রয়েছে অনলাইন সেবা। তবে ডিজিটাল ব্যাংকে মোবাইল বা কম্পিউটারে অ্যাপ ব্যবহার করে গ্রাহকরা সব লেনদেন করতে পারবেন। ব্যাংকের নিজস্ব কোনো শাখা বা উপশাখা না থাকলেও প্রধান একটি কার্যালয় থাকতে পারে। তাদের এটিএম কার্ড বা এজেন্ট ব্যাংকিংও থাকবে না। তবে ভার্চুয়াল কার্ড, কিউআর কোড বা অন্য প্রযুক্তিনির্ভর সেবা থাকবে। জাতীয় পরিচয়পত্রসহ নিজস্ব তথ্যাদি আপলোড করে একজন হিসাব খুলতে পারবেন। একইভাবে ঋণ নেওয়ার জন্যও প্রয়োজনীয় নথিপত্র ডিজিটাল ব্যাংকের পোর্টালে আপলোড করে ঋণের আবেদন করতে পারবেন। অন্য ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবহার করেও টাকা জমা করা যাবে। আবার অন্যদের অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা পাঠিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি অন্য ব্যাংকের এটিএম বুথ বা এজেন্টদের সেবা ব্যবহার করে নগদ অর্থ উত্তোলন করা যাবে।

ডিজিটাল ব্যাংক ছোট আকারের ঋণ দিতে পারবে, বড় বা মাঝারি শিল্পে কোনো ঋণ দিতে পারবে না। বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনের জন্য ঋণপত্রও খুলতে পারবে না এসব ব্যাংক। প্রযুক্তিনির্ভর সেবা হওয়ায় এসব ব্যাংকের কোনো কোনো সেবা দিন রাত ২৪ ঘণ্টাই পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইনে বলা হয়েছে, প্রচলিত ব্যাংকের মতো ডিজিটাল ব্যাংকেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব বিধিবিধান, নির্দেশনা মেনে চলতে হবে এবং নজরদারির মধ্যে থাকবে। তাদেরও আমানতের একটা অংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে সিআরআর এবং এসএলআর হিসেবে জমা রাখতে হবে। প্রচলিত ব্যাংক সময়নির্ভর, অনেক সেবার জন্য সশরীরে যেতে হয়। ঋণ নেওয়া, আমানত খোলা, স্টেটমেন্ট নেওয়ার জন্য অনেক সময় ব্যাংকে যেতে হয়। সেখানে গিয়ে কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়। কিন্তু ডিজিটাল ব্যাংকে সেসব করতে হবে না। কিন্তু সব ধরনের সেবাই পাওয়া যাবে। লেনদেনের সব বিষয় হবে ২৪ ঘণ্টা ভার্চুয়ালি। ব্যাংকে যেতে না হওয়ায় গ্রাহকদের যাতায়াতের সময় সাশ্রয় হবে। ব্যাংকের শাখার ভাড়াসহ পরিচালন ব্যয় অনেক কমে যাবে। ফলে ব্যাংকগুলো সাশ্রয়ে কম খরচে গ্রাহকদের সেবা দিতে পারবে। বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে গ্রাহক অ্যাকাউন্ট খুলতে এবং ব্যাংকিং সেবা নিতে পারবেন। নতুন প্রজন্ম প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থার তুলনায় এ ধরনের ব্যাংকিংয়ে বেশি আগ্রহী হবে বলে আশা করা যায়। সিঙ্গাপুর, ফিলিপিনের মতো দেশেও প্রচলিত ব্যাংকের তুলনায় ডিজিটাল ব্যাংক মানুষ বেশি পছন্দ করছে বলে জানা যায়। প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশ সব সময় এগিয়ে থাকে। তাই আশা করা যায়, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবা যেভাবে মানুষের কাছে জনপ্রিয় এবং সমাদৃত হয়েছে তেমনি আধুনিক ব্যাংকিং সেবা ডিজিটাল ব্যাংকিংও তেমনি সমাদৃত হবে।

আনোয়ার ফারুক তালুকদার : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here