ঢাকায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু ভবিষ্যতেও বাড়বে, শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

0
74

ঢাকা: দেশের ইতিহাসে চলতি বছরে ইতোমধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ডেঙ্গুর সংক্রমণ এক সময় ঢাকা কেন্দ্রিক হলেও বর্তমানে সারা দেশেই এ রোগের বিস্তার ঘটেছে।

মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে দুই হাজার ১৬৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা সিটিতে ৮৪২ জন এবং সারা দেশে (ঢাকা সিটি ব্যতীত) এক হাজার ৩২৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

চলতি বছরের ২২ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন মোট এক লাখ চার হাজার ৩৫৯ জন। এর মধ্যে ঢাকা সিটিতে ৫০ হাজার ১৭০ জন ও সারা দেশে (ঢাকা সিটি ব্যতীত) ৫৪ হাজার ১৮৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন।

গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ৪৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা সিটিতে ৩৬৬ জন এবং সারা দেশে (ঢাকা সিটি ব্যতীত) ১২৭ জন মারা যায়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে চার ধরনের ডেঙ্গুর প্রকোপ রয়েছে ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ এবং ডেন-৪। এক ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে পরবর্তী সময়ে সেই নির্দিষ্ট ধরনের বিরুদ্ধে দেহ স্বাভাবিকভাবে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে। কিন্তু অন্য আরেকটি ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তখন ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়ে। তখনই রোগীর মধ্যে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বা ডেঙ্গুজনিত রক্তক্ষয়ের ঘটনা ঘটে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সংক্রমণ রোগে আক্রান্ত বেশি হলে মৃত্যুও বেশি হবে। কিন্তু এবারের ডেঙ্গু জ্বরে দেখা যাচ্ছে। সারা দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলেও মৃত্যুর সংখ্যা ঢাকায় অনেক বেশি প্রায় তিনগুণ।  

১৯৬৪ সালে ঢাকা জ্বর বা ঢাকা ফিভার নামের অজ্ঞাত এক অসুখ মহামারি হয়ে দেখা দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সিরোটাইপিং হিসেবে পরিচিত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ঢাকা জ্বর আসলে ডেঙ্গু জ্বর। ২০০০ সাল থেকে দেশে ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে ২০০০ সালে দেশে সাড়ে পাঁচ হাজার জন ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০০১ সালে আড়াই হাজার লোক ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ৪৪ জনের মৃত্যু হয়।

২০০২ সালে ছয় হাজার লোক ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি হয়, ৫৮ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৩ সালে ৪৮৬ জন ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি হয়, মারা যায় ১০ জন। ২০০৪ সালে চার হাজার লোক ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি হয়, ১৩ জন মারা যায়।

২০০৫ সালে এক হাজার ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, চারজনের মৃত্যু হয়। ২০০৬ সালে দুই হাজার ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, মারা যায় ১১ জন।
২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আড়াই হাজার ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হলেও কেউ মারা যাননি। ২০১১ সালে দেড় হাজার লোক ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি হয়, ছয়জন মারা যায়।  

২০১২ সালে ৬৭১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়, একজনের মৃত্যু হয়। ২০১৩ সালে প্রায় দুই হাজার জন হাসপাতালে ভর্তি হয়, দুইজনের মৃত্যু হয়। ২০১৪ সালে ৩৭৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হলেও মৃত্যু নেই।  

২০১৫ সালে তিন হাজার ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, মারা যায় ছয়জন। ২০১৬ সালে ছয় হাজার ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, মারা যায় ১৪ জন। ২০১৭ সালে তিন হাজার ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, মারা যায় আটজন।  

২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়, মারা যায় ২৬ জন। ২০১৯ সালে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়, মারা যায় ১৭৯ জন। ২০২০ সালে দেড় হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হলেও মৃত্যু হয় চারজনের। আর ২০২১ সালে হাসপাতালে ভর্তি হয় সাড়ে ২৮ হাজার ডেঙ্গুরোগী, মারা যায় ১০৫ জন। ২০২২ সালে সর্বমোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং মোট ২৮১ জন মারা যায়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে চললেও সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, ফলে ডেঙ্গু ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ইতোপূর্বে ডেঙ্গু রাজধানী কেন্দ্রিক থাকলেও বর্তমানে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গুরোগীদের অবস্থা খুব তাড়াতাড়ি অবনতি হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে।

ঢাকায় ডেঙ্গুতে বেশি মানুষের মৃত্যু হওয়ার কারণ জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজীর আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ডেঙ্গু জ্বরে ঢাকায় মৃত্যু বেশি হওয়ার দুটি কারণ রয়েছে। একটি হচ্ছে, ঢাকার বাইরে যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা চিকিৎসার জন্য ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে এসে মৃত্যুবরণ করছেন। এই মৃত্যুগুলো ঢাকার মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।

তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে ঢাকায় বেশি মৃত্যুর আরেকটি কারণ হচ্ছে, ঢাকায় বর্তমানে যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে তাদের অধিকাংশই অতীতে ডেঙ্গুর এক বা একাধিক ধরন দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। বর্তমানে যারা ডেঙ্গুর আরেকটি ধরন দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে, তখন আগের অ্যান্টিবডি এবং বর্তমান টাইপের অ্যান্টিজেন, এই দুটোর রিঅ্যাকশনে বেশি জটিলতা তৈরি হচ্ছে। যেমন প্লাজমার লিকেজ হচ্ছে, অর্গান ফেইলর হচ্ছে, শক সিনড্রোমে চলে যাচ্ছে, এগুলো তাদেরই বেশি হচ্ছে যারা এক বা একাধিক ডেঙ্গুর ধরন দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল।

এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, যেহেতু ঢাকায় প্রায় ২৩ বছর ধরে ডেঙ্গু হচ্ছে। আমাদের যারা ঢাকায় থাকি তাদের পরীক্ষা করলে দেখা যাবে অনেকেই দুই বা তিন ধরনের ডেঙ্গু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। যখন আরেকটি টাইপ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছি তখন জটিলতা বেশি তৈরি হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে ঢাকায় মৃত্যুর হার আরও অনেক বাড়বে। অন্যদিকে এবার যারা আক্রান্ত হবে পরবর্তীতে তাদের জটিলতাও বাড়বে। সুতরাং এই জটিলতা এবং মৃত্যু ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here