মিয়ানমারের তরুণরা পালাতে মরিয়া

0
44

জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে লড়াইয়ে দুর্বল হয়ে পড়া বাহিনীকে শক্তিশালী করতে তরুণ বয়সী সব নারী-পুরুষকে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে নিয়োগের প্রক্রিয়া মাসখানেক পরই শুরু করতে যাচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার।

তাতে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধবিগ্রহে সংকটে থাকা দেশটির তরুণদের মধ্যে। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে স্বজাতির বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে না নিলে বা সামরিক আইন অমান্য করলে যে শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে, সেই আশঙ্কা থেকে এখন দেশ ছাড়ছেন তারা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো ছবি ও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ইয়াঙ্গনে থাইল্যান্ড দূতাবাসের সামনে কাগজপত্র নিয়ে লম্বা লাইনে ভিড় করছেন মিয়ানমারের তরুণরা।

তাদের বরাতে সিএনএন লিখেছে, কীভাবে সেনাবাহিনীতে যোগদান এড়ানো যায়, সেই উপায় খুঁজছেন তারা। প্রয়োজনে অবৈধ উপায়ে হলেও তারা দ্রুত দেশ ছাড়ার কৌঁশল খুঁজছেন। অনেকে আবার মিয়ানমার সেনাবহিনীতে যোগ না দিয়ে উল্টো সরকারবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোতে যোগ দেওয়ার কথাও ভাবছেন।

মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকার এক তরুণী অ্যানা ছদ্ম নামে সিএনএনকে বলেন, “আমরা আতঙ্কের মধ্যে আছি। পালানোর চিন্তাভাবনা করছি। আমি মিয়ানমারে থাকতে পারব বলে মনে হয় না “

গত ১০ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে যোগদান সংক্রান্ত একটি আইন জারির ঘোষণা দেয় মিয়ানমার সরকার। বলা হয়, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সব পুরুষ এবং ১৮ থেকে ২৭ বছর বয়সী সব নারীকে অবশ্যই দুই বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করতে হবে।

আইন জারির তিন দিন পর জান্তা সরকার জানায়, ওই নিয়ম চালু হচ্ছে এপ্রিল থেকে। জান্তা মুখপাত্র জ মিন তুন বলেন, এপ্রিলে নতুন বছরের ছুটির পর থেকে বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ বাস্তবায়নে তারা কাজ করছেন।

অবসরপ্রাপ্ত নিরাপত্তা কর্মকর্তাদেরও সেনাবাহিনীতে ফেরানোর ঘোষণা দেয় সরকার। আর ৪৫ বছর বয়সের মধ্যে থেকে চিকিৎসকদের মত বিশেষজ্ঞদের বাধ্যতামূলক তিন বছর সেনাবাহিনীতে থাকার ঘোষণা দেওয়া হয়।

এই আদেশ কেউ অমান্য করলে তার পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে। জান্তা সরকারের এ আইন প্রয়োগের ঘোষণার পর থেকেই তরুণরা বিদেশের ভিসা সেন্টারগুলোতে ছুটছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তরুণদের বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগদান সংক্রান্ত আইনটি মিয়ানমারে আগে থেকেই ছিল। ২০১০ সালে সামরিক সরকারের সময়ে ওই আইন তৈরি করলেও এতদিন প্রয়োগ হয়নি। এর মাধ্যমে তরুণদের নিজ জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য করা হবে। তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে, আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতারও কারণ হতে পারে এটি। ব্যারাকে না গিয়ে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে ঢুকতে পারে তরুণরা।

কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করছেন, বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করার মরিয়া চেষ্টা হিসেবে মিয়ানমারে জান্তা ওই আইনটি কার্যকর করতে যাচ্ছে।

মিয়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুস এক বিবৃতিতে বলেছেন, “পর্যদুস্ত বাহিনীর হতাশা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা চরম বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। সৈন্যদের হতাহত হওয়ার ঘটনা আর সেনা সদস্য নিয়োগের চ্যালেঞ্জ এখন জান্তার অস্তিত্বের জন্যেই হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“ফ্রন্টলাইনে তারা জোরালো আক্রমণের সম্মুখীন হচ্ছে। আর তরুণ-তরুণীদের সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগের মাধ্যমে তারা বেসামরিক লোকেদের ওপর আক্রমণও দ্বিগুণ করেছে।”

২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে দেশটির সশস্ত্র বাহিনী। অভ্যুত্থান রক্তপাতহীনভাবে হলেও পরে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে মিয়ানমার জুড়ে তীব্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। জান্তা সরকার কঠোর হাতে ওই বিক্ষোভ দমন করে। বহু বিক্ষোভকারী প্রাণ হারান, গ্রেপ্তারও হন।

সে সময় বড় বড় শহরগুলোতে বিক্ষোভ দমন করা সম্ভব হলেও বিভিন্ন রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে আদিবাসী বিচ্ছিন্নতাবাদী নানা সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর লড়াই শুরু হয়।

গত বছর শেষভাগে বিচ্ছিন্নতাবাদী কয়েকটি দল জোট গঠন করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তুমুল আক্রমণ শুরু করে এবং গত কয়েক মাসে সেনাবাহিনীকে হারিয়ে তারা বেশ কিছু এলাকার দখল নেয়।

সামরিক জান্তাবিরোধী একটি বিদ্রোহী জোট উত্তরাঞ্চলের বেশি কিছু অংশ দখল করে নিয়েছে। ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ নামের সেই জোটে রয়েছে ‘তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি’ (টিএনএলএ), ‘আরাকান আর্মি’ (এএ) এবং ‘মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি’ (এমএনডিএএ) ।

মিয়ানমারের নির্বাসিত জাতীয় ঐক্য সরকারের সশস্ত্র গোষ্ঠী জোট ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস’ এর আক্রমণেও সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পিস ইনসিটিউটের বিশ্লেষণ বলছে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে দেড় লাখ সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে ৭০ হাজার সেনা সদস্য, যারা একটি যোদ্ধা বাহিনী হিসেবে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে সক্ষম নয়। আর ২০২১ সালে অভ্যুত্থানের পর থেকে অন্তত ৩০ হাজার সৈন্য হারিয়েছে জান্তা সরকার।

এ সরকারের মুখপাত্র জ মিন তুন বলেন, মিয়ানমারের ১ কোটি ৩০ লাখ তরুণ নারী-পুরুষ বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য যোগ্য। এর মধ্যে ৬০ হাজার পুরুষকে প্রথম পর্যায়ে এপ্রিলে নিয়োগ করা হবে।

তবে তাদের কীভাবে সেনাবাহিনীতে ডাকা হবে, কী প্রশিক্ষণ তারা পাবে, সে ব্যাপারে তেমন কিছু জানা যায়নি। তরুণ বয়সীরা ওই আইন নিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত্র।

তারা মনে করছেন, তাদের ফ্রন্টলাইনে পাঠানো হতে পারে। পাহাড় আর জঙ্গলে তাদের পাঠানো হতে পারে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়াই।

ইয়াঙ্গন অঞ্চলের ২৮ বছর বয়সী শিক্ষক কিয়াও নায়িং ছদ্মনামে সিএনএনকে বলেন, “আইনে যাই লেখা থাকুক না কেন, নিয়োগকৃতদের সামনের সারিতেই পাঠানো হবে বলে তারা নিশ্চিত। এ ব্যাপারে দেশের কারো সন্দেহ নেই।”

মিয়ানমারের নির্বাসিত ছায়া সরকারের মানবাধিকার মন্ত্রী অং মিয়ো মিন বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী থেকে গণহারে পালিয়ে যাওয়ার খবর তারা পেয়েছেন। দলছুট এসব সেনা সদস্যরা জানাচ্ছেন, তাদের কাছে পর্যাপ্ত খাবার নেই। বেসামরিক লোকেদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের বাধ্য করা হচ্ছেন।

এ অবস্থায় বাধ্যতামূলক আইন প্রয়োগে জান্তা সরকারে কঠোর হওয়ার আশঙ্কা করছেন তরুণ বয়সীরা।

মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকার তরুণী অ্যানা বলেন, দেশের বাইরে চলে যাওয়ার মত তার টাকা আর যোগাযোগ তার নেই। তাছাড়া বিমানবন্দরে তরুণ বয়সীদের ওপর নজর রাখবে জান্তা সরকার। তাদের বিদেশ যাওয়া ঠেকিয়ে গ্রেপ্তার করাও হতে পারে।

অ্যানার বাবা-মা তাকে যত দ্রুত সম্ভব দেশ ছাড়ার কথা বলেছেন। কিন্তু যেহেতু বৈধ উপায়ে দেশের বাইরে যাওয়ার সামর্থ্য বা সুযোগ নেই, সেহেতু অবৈধভাবে সীমান্ত পার হয়ে থাইল্যান্ড যাওয়াই তার জন্য একমাত্র উপায়।

অ্যানার ভাষ্য, “মিয়ানমারে ফেইসবুকে এখন যেসব তথ্য বেশি ঘুরছে, তা হল- কীভাবে দেশ থেকে পালানো যায়।

“আমার দিক থেকে আমি চেষ্টা করব যত দ্রুত সম্ভব পালানোর। কিন্তু যদি সেটা না পারি, তাহলে ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্সে’ যোগ দেব। এর মানে আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here