যেখানে-সেখানে এলপিজির দোকান, বিপর্যয়ের শঙ্কা

0
38

রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলছে এলপিজি সিলিন্ডারের সরবরাহ, মজুদ ও কেনাবেচা। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া যেমন চলছে এ ব্যবসা, তেমনি ছাড়পত্র থাকলেও মানা হচ্ছে না নীতিমালা। বাধ্যতামূলক হলেও অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই নেই অগ্নিনিরোধক ব্যবস্থা। ট্রাকে করে বিপজ্জনকভাবে ভাঙাচোরা পাকা-আধা পাকা সড়ক দিয়ে দোকানে দোকানে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ এ পদার্থ। আবার কাঠফাটা রোদে রাস্তার পাশেই অরক্ষিতভাবে রাখা হচ্ছে সিলিন্ডার। মজুদ করা সিলিন্ডারের পাশঘেঁষেই চলতে দেখা যায় দ্রুতগামী যানবাহন। ফুটপাতে অনেকেই এর পাশে দাঁড়িয়ে ধূমপানও করেন। এমন কি, অনেক আবাসিক ভবন বা বাণিজ্যিক সিঁড়িঘরেও সিলিন্ডারের দোকান গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে যেকোনো সময় যে কোনো স্থানে বড় ধরনের বিপর্র্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সরকারি নীতিমালা অনুসারে, ট্রেড লাইসেন্স, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সনদ ও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র ছাড়া এসব গ্যাসের সিলিন্ডার বিক্রি নিষিদ্ধ। তবে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গ্রাহক চাহিদাকে পুঁজি করে প্রায় প্রতিটি এলাকায় এখন ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির দোকান। এসব দোকানে বিক্রি হচ্ছে মানহীন এবং অনুমোদনহীন সিলিন্ডারও। কোথাও কোথাও নকল সিলিন্ডার এবং ওজনে কম গ্যাস দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে কিছু দোকানির বিরুদ্ধে। এমনও দেখা গেছে, প্রায় এক বছর আগে বিস্ফোরক অধিদপ্তর থেকে সতর্ক করা হলেও তা গ্রাহ্য করা হচ্ছে না।

এ বিষয়ে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মোহাম্মদ ফারুক হোসেন (যুগ্মসচিব) গতকাল সোমবার আমাদের সময়কে বলেন, লাইসেন্স ছাড়া এলপিজি সিলিন্ডার মজুদ ‘এলপিজি বিধিমালা, ২০০৪’ অনুসারে দ-নীয় অপরাধ। এলপিজি সিলিন্ডার ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটরই সরবরাহ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক। হাট-বাজার, এমন কি আবাসিক ভবনের অননুমদিত কোনো দোকানে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে- বিষয়টি অ্যালার্মিং। খুব শিগগিরিই অননুমদিত এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

রাজধানীর পল্লবীর (মিরপুর সাড়ে-১১) সিটি ক্লাব মার্কেটের নিচতলায় সিঁড়িকোঠায় ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে এলপিজি গ্যাস বিক্রির ব্যবসা করছেন মহিউদ্দিন মজুমদার। গতকাল দুপুরে ‘আসিফ এলপিজি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে তার দোকানে গিয়ে ৪০টিরও বেশি সিলিন্ডার দেখা যায়। ফুটপাতেও বেঁধে রাখা হয়েছে সিলিন্ডার। পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন জনৈক পথচারী। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের সনদ ও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব আছে। লাইসেন্স দেখতে চাইলে বলেন সেগুলো বাসায়। সিঁড়িকোঠায় কীভাবে লাইসেন্স পেলেন জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

ভয়াবহ চিত্র নজরে এসেছে রাস্তা পার হয়ে ওপারের একটি বহুতল ভবনে। দেখা গেল- পল্লবী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ২/১২ নম্বর ভবনে অবস্থিত বনলতা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ব্যবহৃত এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডারগুলোর লাইন টেনে আনা হয়েছে পাশের ২/১২ নম্বর ভবনের পাশে সংকীর্ণ স্থানে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে রাখা সিলিন্ডারগুলো অপসারণের জন্য ২০২৩ সালের ৩১ মে বনলতা কফিশপ রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষকে নোটিশ করেন বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সহকারী বিস্ফোরক পরিদর্শক (ঢাকা) সাব্বির আহমেদ।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়- এই রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে পরিদর্শনকালে এম এম কমপ্লেক্স নামক ১০তলা ভবনটিতে দেখা যায়- হোল্ডিং নম্বর ২/১১ ও ২/১২ ভবন দুটির মধ্যবর্তী সংকীর্ণ স্থানে এক সারিতে ৪৫ কেজি ধারণক্ষমতার প্রায় ৩০টি এলপিজি সিলিন্ডার রয়েছে। সিলিন্ডারগুলোর মধ্যে ১৬টি এলপিজি সিলিন্ডার রেটিকুলেটেড পদ্ধতিতে স্থাপন করা হয়েছে। লাইসেন্সব্যতীত এলপিজি সিলিন্ডার মজুদ এলপিজি বিধিমালা, ২০০৪ অনুসারে দ-নীয় অপরাধ। বেআইনি ও বিপজ্জনকভাবে এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহারের সময় যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে এরূপ বেআইনি কার্যক্রম এই চিঠি প্রাপ্তির ৫ কার্যদিবসের মধ্যে ভবন দুটির মধ্যবর্তী সংকীর্ণ স্থান থেকে অবৈধভাবে ৩০টি সিলিন্ডার দ্রুত অপসারণ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো। তবে এই চিঠির প্রায় ১০ মাস পর গতকালও একই জায়গায় বেশ কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার দেখতে পাওয়া যায়।

বনলতা কফি শপের জেনারেল ম্যানেজার মো. হাফিজুর রহমান বলেন, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের নোটিশ পেয়েছি। অগ্নিকা- যেন না ঘটে সেজন্য আমরা সব ব্যবস্থাই নিয়েছি। ফায়ার সার্ভিস ও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা এসে দেখে গেছেন। তারা সন্তুষ্ট।

শুধু এই দুই প্রতিষ্ঠানই নয়, সরেজমিনে মিরপুর ১, ২, ১০, ১১, ১২, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, দারুসসালাম, গাবতলী, ভাসানটেক, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা হাতিরঝিলের মধুবাগসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। তাদের অধিকাংশেরই নেই ফায়ার লাইসেন্স। দোকানে নেই কোনো অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র। এ নিয়ে স্থানীয়দের অনেকে দুর্ঘটনার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এই প্রতিবেদকের কাছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে অধিকাংশ এলাকায় চলছে এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রির ব্যবসা। সনদ ছাড়া একজন ব্যক্তি ১০০ কেজি অর্থাৎ ১২ কেজি ওজনের ৮টি এবং ২৩ ও ২৪ কেজি ওজনের চারটি গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার সংরক্ষণ করতে পারবেন বলে নিয়মে রয়েছে। কিন্তু সনদপত্র ছাড়াই অধিকাংশ গ্যাস বিক্রেতা শত শত গ্যাস সিলিন্ডার মজুদ ও বিক্রি করছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ১০টির কম সিলিন্ডার দোকানে থাকলে লাইসেন্সের প্রয়োজন হবে না এমন আইনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে অধিকাংশ এলপি গ্যাস ব্যবসায়ী ছোটখাটো দোকানে বৈধ লাইসেন্স না নিয়েই অবৈধভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। আর যাদের লাইসেন্স আছে, তাদের অনেকেরই নেই বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্সের মেয়াদ।

বিস্ফোরক আইন, ১৮৮৪-এর দ্য এলপি গ্যাস রুলস ২০০৪-এর ৬৯ ধারার ২ বিধিতে লাইসেন্স ছাড়া কোনো ক্ষেত্রে এলপিজি গ্যাস মজুদ করা যাবে, তা উল্লেখ আছে। একই বিধির ৭১ নম্বর ধারায় বলা আছে, আগুন নেভানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি রাখতে হবে। এই আইন অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর ২ বছর, অনধিক ৫ বছরের জেল এবং ৫০ হাজার টাকা দ-িত হবেন এবং অর্থ অনাদায়ী থাকলে অতিরিক্ত আরও ছয় মাস পর্যন্ত কারাদ-ের বিধান রয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here