দীর্ঘদিন পর কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে ঐকমত্যে পৌঁছেছে ইরান ও সৌদি আরব। এশিয়ার দেশ চীনের মধ্যস্থতায় দীর্ঘ সাত বছর দুই দেশের হিমশীতল সম্পর্কের বরফ গলানো সম্ভব হল।
মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশের এই পদক্ষেপে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে আঞ্চলিক প্রতিবেশীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, “সাধারণভাবে বলতে গেলে, আমরা ইয়েমেন যুদ্ধের অবসান এবং মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে উত্তেজনা কমাতে সহায়তার জন্য যেকোনও প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই।
হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি এক প্রতিক্রিয়ায় এ কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, “রাষ্ট্রপতি বাইডেন গত বছর এই অঞ্চলে সফরের সময় উত্তেজনা প্রশমন এবং কূটনীতি সংক্রান্ত নীতির রূপরেখা দিয়ে গেছেন।”
কিরবি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিকে স্বাগত জানালেও ইরান তাদের বাধ্যবাধকতা পূরণ করবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান ওয়াশিংটন।
এদিকে, সংযুক্ত আরব আমিরাত বলেছে- তারা এই চুক্তিকে স্বাগত জানায় এবং আলোচনায় চীনের ভূমিকাকে ‘মূল্যবান’ মনে করছে দেশটি।
দেশটির ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা আমিরাত প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ বলেন, “আমরা ভাল প্রতিবেশীর ধারণা সুসংহত করতে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ইতিবাচক যোগাযোগ এবং সংলাপের গুরুত্বে বিশ্বাস করি।”
শুক্রবার কাতার নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, কাতারের প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান বিন জসিম আল-থানি সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহানের সাথে ফোনালাপের সময় এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তিনি দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তির পুনঃসক্রিয়তা এবং অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, ক্রীড়া এবং যুব ক্ষেত্রে সাধারণ সহযোগিতা চুক্তিকে অভিনন্দন জানান।
তিনি আরও বলেন, “এই পদক্ষেপ ‘আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। সেই সঙ্গে সমগ্র অঞ্চলের স্বার্থ ও দুই দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে।”
ইরাক এবং ওমানও সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। উভয় দেশের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা এই তথ্য জানিয়েছে।
এক বিবৃতিতে ইরাক জানিয়েছে, তারা ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে ‘একটি নতুন অধ্যায় চালুর’ এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়।
ওমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আলবুসাইদি বলেছেন, “এতে উভয়পক্ষের জয় হয়েছে এবং তাদের এই সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তাকে উপকৃত করবে। আমরা আশা করি এই পদক্ষেপে দীর্ঘমেয়াদে সবার জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা বাড়ানোর সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হল।”
এছাড়া বাহরাইন, আলজেরিয়া, তুরস্ক, লেবানন ও সুদানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ইরান-সৌদির চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করেছে।
বাহরাইন বলেছে, তারা আশা করে যে চুক্তিটি মতভেদ নিরসনে এবং আলোচনা ও কূটনৈতিক উপায়ে সমস্ত আঞ্চলিক সংঘাতের অবসানে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে ভূমিকা রাখবে।
কুয়েতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, চুক্তিটি আস্থা তৈরি করা এবং উভয় দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করবে, যা এই অঞ্চলের প্রতিবেশী দেশসমূহ ও সমগ্র বিশ্বের স্বার্থে কাজ করবে।
জর্ডান এক বিবৃতিতে বলেছে, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার এই সমঝোতা উভয় দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে।
চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে সিরিয়া বলেছে, এটি এই অঞ্চলকে আরও স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাবে। বিশেষ করে এই চুক্তি দুই দেশের জনগণ এবং সাধারণভাবে এই অঞ্চলের জনগণের অভিন্ন স্বার্থের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটাবে।
উল্লেখ্য, গত ৬ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর সৌদি আরব ছিল সিরিয়ার সরকার-নিয়ন্ত্রিত অংশে সহায়তা সরবরাহকারী কয়েকটি আরব দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু তার সৌদি সমকক্ষ প্রিন্স ফয়সালের সঙ্গে ফোনে এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টা জারদারি বলেছেন, সৌদি আরব ও ইরানের এই সিদ্ধান্তে দুই দেশের নেতৃত্বকে অভিনন্দন জানায় তার দেশ।
তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্ব এমন একটি অবস্থায় রয়েছে যেখানে আমরা দুর্ভাগ্যবশত আর ভাল খবর পেতে অভ্যস্ত নই। এই সময় এই চুক্তিটি সত্যি সত্যিই দুর্দান্ত।
গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিলের মহাসচিব জাসেম মোহাম্মদ আলবুদাইবি বলেছেন, চুক্তিটি ‘নিরাপত্তা ও শান্তি বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে’ বলে তিনি ও তার সংস্থা আশাবাদী ।
আর আরব পার্লামেন্ট বলেছে, চুক্তিটি এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগও এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।
ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সেক্রেটারি-জেনারেল হুসেইন ইব্রাহিম ত্বহা বলেছেন, চুক্তিটি এই অঞ্চলে শান্তি, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার স্তম্ভগুলোকে শক্তিশালী করতে অবদান রাখবে এবং ওআইসির সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার নতুন প্রেরণা জোগাবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের পক্ষে সংস্থাটির মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিকও ইরান-সৌদি আরবের এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, মহাসচিব এই উদ্যোগের পদক্ষেপ এবং দুই দেশের মধ্যে সংলাপ উন্নীত করার জন্য চীনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে মহাসচিব এ বিষয়ে ওমান সালতানাত ও ইরাকের মতো অন্যান্য দেশের প্রচেষ্টারও প্রশংসা করেছেন। তিনি মনে করেন উপসাগরীয় অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সুসম্পর্ক অপরিহার্য। সূত্র: আরব নিউজ