সরকারের কয়েকশো কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া ২১ মামলার আসামি বিএনপি নেতা হাবিবুর রহমান অপু চাকলাদার জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে বিদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। দীর্ঘদিন রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে পলাতক থাকার পরে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। জানুয়ারি মাসে জেল থেকে বের হওয়ার জন্য শুনানির তারিখ না থাকা সত্ত্বেও আইনজীবীরা তার মামলা উত্থাপন করলে বিচারক সেটি বাতিল করেন।এই নিয়ে আদালতে আইনজীবীরা তার জামিন কেন দেয়া হবে না এই জন্য বিচারকের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন এবং এজলাসে হট্টগোল করেন। বর্তমানে তিনি কারাগারে থাকলেও উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে বিএনপি নেতা হাবিবুর রহমান অপু চাকলাদার।একই মামলায় ছোট ভাই আওয়ামী লীগ নেতা দিপু চাকলাদার পলাতক রয়েছে।

বাংলায় প্রবাদ আছে ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যায়। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার চিরায়ত বাগধারার সঙ্গে মিল রেখে একই ধরণের কাজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।শুধু তাই নয় গুরুতর অপরাধের এজারভুক্ত আসামি যখন নাকের ডগায় ঘোরাফেরা করেন,অন্য মামলায় কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে সোজা এয়ারপোর্ট হয়ে বুক চেতিয়ে ইমিগ্রেশন অতিক্রম করেন বিদেশ চলে যায়-তখনও হুঁশ হয় না সংস্থাটির। এমনই ঘটনা ঘটতে চলেছে চট্টগ্রাম কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা পাসওয়ার্ড হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে সরকারের ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও অর্থ পাচার মামলার আসামি হাবিবুর রহমান অপু চাকলাদারের ক্ষেত্রেও।
হাবিবুর রহমান অপু ওরফে অপু চাকলাদার নিছক কোনো সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট’র মালিক নন। অপু-দীপু দুই ভাই দেশের সাইবার অপরাধ জগতে নতুন এক ধারার জন্মদাতা। যারা কাস্টমস কর্মকর্তাদের হাত করে অ্যাসাইকুডা পাসওয়ার্ড হ্যাক করে কাস্টমস থেকে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়েছেন কন্টেইনার। যা থেকে সরকার অন্তত: ২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে।

এই ক্ষমতাশালী অপরাধী দীপু-অপু চাকলাদার সম্পর্কে যতটা জানা যায়, শেখ হাসিনার মাফিয়াতন্ত্রের সুযোগে অপু-দীপু মালিকানাধীন সিএন্ডএফ এজেন্ট ‘মুভি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’ ২০১৭ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত জালিয়াতির মাধ্যমে কাস্টমসের ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের সাবেক ২ কর্মকর্তার ইউজার আইডি ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে ‘লগইন’ করে অবৈধভাবে মালামাল খালাস করেন অপু চাকলাদার-দীপু চাকলাদার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা এবং সিআইডি’র তদন্তে উঠে আসে এমন তথ্য। শেখ পরিবারের আশীর্বাদপুষ্ট এক প্রভাবশালী শুল্ক গোয়েন্দার সহায়তায় আত্মসাৎ হয় এই অর্থ আত্মসাৎ। কিন্তু সেই কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে সিআইডি। জালিয়াতির ১৮টি মামলা সিআইডি তদন্ত করলেও যেহেতু ঘটনার সঙ্গে কাস্টমসের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সেহেতু সবগুলো মামলা তদন্তের ভার পরে দুদকের ওপর।সিআইডি’র হাতে গ্রেফতার হন দীপু চাকলাদারসহ সংশ্লিষ্ট আসামি পণ্য আমদানিকারক মফিজুল ইসলাম লিটন, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কর্মচারী সিরাজুল ইসলাম ও সোহরাব হোসেন লিপন।

তদন্তে বেরিয়ে আসে, দুই বছরে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের সাবেক ২ কর্মকর্তার ইউজার আইডি ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ৭৭৭টি চালান অবৈধভাবে খালাস করা হয়েছে। এতে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে। তদন্তে কন্টেইনার পাচার চক্রে জড়িত ৫ আমদানিকারক ৮ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও বিভিন্ন স্তরের অন্তত ১২ শুল্ক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শনাক্ত করা হয়।
গ্রেফতারকৃত লিটন (আমদানিকারক) আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন। আলোচিত এই মামলার প্রধান দুই আসামি মিজানুর রহমান দীপু এবং হাবিবুর রহমান অপু। এদের মধ্যে আওয়ামী শাসনামলে মিজানুর রহমান দীপু মরহুম অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সাগুফতা ইয়াসমিন অ্যামিলি,সানজিতা খানম, এএম আমিনউদ্দিন, ঢাকা দক্ষিণ সিটির পলাতক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ডিবি হারুন, নসরুল হামিদ দীপু, শাহীন আহমেদ,ইসমাইল হোসেন সম্রাটের শেল্টারে চলতেন। এর ফলে গ্রেফতার হয়েও দ্রুততম সময়ের মধ্যে কারামুক্ত হন দীপু। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার উৎখাতের পর কারামুক্ত দীপু পালিয়ে যান। অন্যদিকে হাবিবুর রহমান অপু ধরেন ‘বিএনপি’র লাইন’।

দীর্ঘদিন পলাতক থেকে কয়েক মাস আগে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন হাবিবুর রহমান অপু চাকলাদার।পরে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানো নির্দেশ দেন। ধারণা ছিলো এক দরজা দিয়ে কারাগারে প্রবেশ করবেন-অন্য দুয়ার দিয়ে ক্ষমতার দাপটে বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু সেটা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন। কারাগার থেকে তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেওয়ার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা করছেন এবং জামিন নিয়েই দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে হাবিবুর রহমান হাবিবুর রহমান অপু চাকলাদার।কিন্তু অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বিচারকদের নির্ভয়ে বিচার কার্যক্রম পরিচালনার সাহস যোগান।এর প্রেক্ষিতে গত ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন একটি মামলায় হাবিবুর রহমান অপু ওরফে অপু চাকলাদারের মামলা ওঠে জামিনের জন্য। তাকে ‘মুন্সিগঞ্জ জেলার গুরুত্বপূর্ণ বিএনপি নেতা’ এবং ‘কিডনি রোগে আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থ’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।কিন্তু অপরাধের ভয়াবহতা ও ধরণ বিবেচনায় বিচারক নূরে আলম জামিন নামঞ্জুর করেন।এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বারের বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা একাট্টা হয়ে নূরে আলমের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। তাকে এজলাস থেকে নামিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে। বিচারক নূরে আলমের বিরুদ্ধে টানা তিন দিন কর্মবিরতিও পালন করেন আইনজীবীরা। প্রতিক্রিয়ায় বিচারকদের জাতীয় সংগঠন ‘বাংলাদেশ জুডিসিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’ কঠোর অবস্থান নেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বিচারকের নিরাপত্তা প্রশ্নে তারাও পাল্টা হুঁশিয়ার দেন। অর্থাৎ, একজন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অপু চাকলাদার প্রশ্নে বিচার বিভাগ এবং আইনজীবীরা মুখোমুখি অবস্থান নেন। অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় সাইবার ট্রাইব্যুনালে।অপু চাকলাদারের জামিনের বিষয়টি যখন ‘বিচারাধীন’-তখন ১২ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এসএম আব্দুল মোবিন এবং বিচারপতি মাহমুদ হাসান তালুকদারের ডিভিশন বেঞ্চে ক্রিমিনাল আপিল (নং-৪৯৫,৪৯৬,৪৯৭,৪৯৮,৪৯৯,৫০০/২০২৫) করা হয়। অপুর পক্ষে শুনানির জন্য দাঁড়িয়ে যান অ্যাডভোকেট মো শিশির মনিরের মতো জাঁদরেল আইনজীবী।

জামিনে বিরোধিতা করার কথা থাকলেও অপুর পক্ষে জামিনে সহযোগিতা করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো: রফিকুল ইসলাম মন্টু। তবে বিষয়টি অবহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান ডিএজি মন্টুকে ওই আদালত থেকে সরিয়ে দেন বলে জানা যায়। অপু চাকলাদারের ক্রিমিনাল আপিল শুনানির বিষয়টি যদিও ওইদিন বেঞ্চটির দৈনন্দিন কার্যতালিকায় (প্রিন্ট ভার্সন) ছিলো না। অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে জামিন হয় অপুর। পরে অবশ্য জামিন আদেশ ভ্যাকেটের জন্য ক্রিমিনাল পিটিশন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আপিল বিভাগে হাজার হাজার মামলা ‘পেন্ডিং’ রয়েছে। অথচ শুধুমাত্র অপু চাকলাদারের জামিন সংক্রান্ত ৬ মামলা শুনানির জন্য কার্যতালিকায় উঠছে।মামলা আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ওঠনোর ক্ষেত্রে অপুর হয়ে সহযোগিতা করছেন একজন বেঞ্চ অফিসার।

এ দিকে দুদকের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, দীপু-অপু গংয়ের বিরুদ্ধে জালিয়াতি,অবৈধ সম্পদ এবং অর্থ পাচারের অন্তত: ২১টি মামলা তদন্তাধীন থাকলেও দীপু-অপুর মামলার বিষয়ে বর্তমান কমিশন ওয়াকিবহাল নয়। গুরুতর অপরাধের এই দুই আসামি কারাগারে নাকি জামিনে, নাকি পলাতক রয়েছেন-এ সংক্রান্ত হালনাগাদ কোনো তথ্যও কমিশনের কাছে নেই। মামলাগুলোর তদন্ত চলছে দুদকের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় ও চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয় থেকে।অন্য মামলায় গ্রেফতার থাকলেও মামলা-নং-১৪/২২,১৫/২২,১৬/২২,২৬/২২ নম্বর মামলায় অপু-দীপু এখনো গ্রেফতার করা হয়নি। ফলে কারামুক্ত হওয়া মাত্র হাবিবুর রহমান অপু ওরফে অপু চাকলাদার যেকোনো ছুতোয় দেশত্যাগের পরিকল্পনা করেছেন-বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। দেশত্যাগের লক্ষ্যে কারাগারে থেকেই অপু চাকলাদার জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় পাসপোর্টও তৈরি করেছেন বলে জানা গেছে। ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ মামলার আসামি অপু চাকলাদার কারামুক্ত হওয়া মাত্র দেশত্যাগ করবেন বলে নিশ্চিত করে সূত্রটি।
এদিকে সক্রিয় ২টি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র জানায়, মিজানুর রহমান দীপুকে আ’লীগ নেতারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে দেশ ছাড়তে সহযোগিতা করেছেন। অপু চাকলাদারকে সহযোগিতা করছেন বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন নেতা।
গোয়েন্দা সূত্রটি জানায়, অপু চাকলাদার বড় শুভাকাঙ্খি ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি বিএনপি’র রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানো সাবেক এক প্রতিমন্ত্রী।
বিএন//